একই জমি, ঠিকানাও এক। ওই জমিই বন্ধক রেখে ব্যাংকঋণ নেয়া হয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিয়েছে গ্রাহক খেলাপি হওয়ার পর, বন্ধকি জমি নিলামে তুলতে গিয়ে। অন্যের জমি বন্ধক দেখিয়ে ঋণ নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমনটা হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি ব্যাংক শাখায়। এতে ক্ষতিতে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলার অভাবকেই এজন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ দেয়ার আগে নিয়ম মানা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমির মালিকানা না দেখেই ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমার্স ব্যাংক চট্টগ্রামের জুবিলী রোড শাখা থেকে ২০০৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঋণ নেন ইভান ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী জাবেদ বিন মাহমুদ। ২৫ লাখ টাকা ঋণ পেতে ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখেন নগরীর কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকার ভবনসহ ৪ দশমিক ৫ শতক জমি। নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ওই জমি নিলামে তোলে কমার্স ব্যাংক।
একই সম্পত্তি বন্ধক রেখে জাস কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্টের নামে ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (আইএফআইএল) আগ্রাবাদ শাখা থেকেও ঋণ নেন জাবেদ বিন মাহমুদ। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৯৫ লাখ টাকার ঋণ নেন ওই ব্যবসায়ী। পত্রিকায় দেয়া কমার্স ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি দেখে বিষয়টি নজরে আসে আইএফআইএলের। পরে তারা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এ নিয়ে অভিযোগ জানায়।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড জুবিলী রোড শাখার প্রধান এস এম আমির হোসাইন বলেন, দুদকের মাধ্যমে জানতে পারি, প্রতিষ্ঠানটি একই সম্পত্তি বন্ধক রেখে ২০০৬ সালে আরো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে। বন্ধকি সম্পত্তির কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করায় এমনটা ঘটছে।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেডের (আইসিবিআইএল) খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১৯৯৯ সালে ঋণ নেন পদ্মা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বাদশা মিয়া। এ ঋণ পেতে নগরীর বাকলিয়া ও কাঠগড় এলাকার ৩৯ শতাংশ জমি বন্ধক রাখেন তিনি। যথাসময়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করায় চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের দ্বারস্থ হয় আইসিবিআইএলের সংশ্লিষ্ট শাখা। ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট মামলা দায়েরের সময় এ ব্যবসায়ীর কাছে আইসিবিআইএলের মোট পাওনা দাঁড়ায় ১৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
বাকলিয়া এলাকার একই জমি বন্ধক রেখে মেসার্স মীম এন্টারপ্রাইজের নামে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) জিইসি শাখা থেকে ঋণ নেন বাদশা মিয়ার ছেলে রাশেদ উদ্দিন চৌধুরী বাবু। রাশেদ উদ্দিন চৌধুরী নিজে ও আমমোক্তারনামার মাধ্যমে এ সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখেন। নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় ২০১৪ সালের ১৩ জুলাই চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। আদালতের তথ্যমতে, মীম করপোরেশনের কাছে এসআইবিএলের পাওনার পরিমাণ ৯৪ কোটি ৯ লাখ টাকা।
আইসিবিআইএলের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী শামীমা ফেরদৌস মিলি বলেন, মেসার্স পদ্মা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বাদশা মিয়া ১৯৯৯ সালে নগরীর দুটি মৌজার জমি বন্ধক রেখে আইসিবিআইএল থেকে ঋণ নেন। টাকা ফেরত না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা চলছে। তবে একই সম্পত্তি বন্ধক রেখে আরেকটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন বাদশা মিয়ার ছেলে রাশেদ উদ্দিন চৌধুরী। ভুয়া আমমোক্তারনামার মাধ্যমে একই সম্পত্তি বন্ধক রেখে রাশেদ উদ্দিন চৌধুরী এ ঋণ নেন।
জানতে চাইলে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ঋণগ্রহীতারা যদি জালিয়াতির আশ্রয় নেয়, তাহলে আমরা কী করতে পারি। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকও ভালোভাবে জমির মালিকানা দেখেনি। তবে এখন ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্ক।
অন্যের জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতেও। সূত্রমতে, ইসলামী ব্যাংক মতিঝিল স্থানীয় শাখার অনুকূলে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে ২০০৬ সালে সুরাইয়া আক্তারের নামে ডিক্রি জারি করেন ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৪। অর্থ পরিশোধ না হওয়ায় একই আদালতে এক্সিকিউশন মামলা হয় এবং ২০১০ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সুরাইয়া আক্তারের ৪৬ শতক জমি ব্যাংকের অনুকূলে দখলের সনদ দেন আদালত। আদালতের সনদ নিয়ে ওই জমি বিক্রি করে দেয় ব্যাংক। নতুন মালিক জমির দখল নিতে গেলে সুরাইয়া আক্তার জানতে পারেন, তার জমি জামানত দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ঢাকা টেক লিমিটেড।
রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকার আবদুল নাঈমের জমি বন্ধক দেখিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের রমনা শাখা থেকে ঋণ নেয় কন্টিনেন্টাল শিপ ব্রেকার্স লিমিটেড। ১৯৮৫ সালে নেয়া ওই ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় ঢাকার অর্থঋণ আদালত-১-এ মামলা করে ব্যাংকটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালের ২০ মে ব্যাংকের অনুকূলে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ডিক্রি জারি করে আবদুল নাঈমকে তা পরিশোধের নির্দেশ দেন আদালত। ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর সহকারী কমিশনারের (ভূমি) মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, তার জমি বন্ধক দেখিয়ে ঋণ নিয়েছিল কন্টিনেন্টাল শিপ ব্রেকার্স লিমিটেড।
এর আগে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে জমির ভুয়া দলিল দিয়ে চট্টগ্রামের দুটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় এক প্রতারক। ২০০৪ সালের ১২ মে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ৩ কোটি ও একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর পূবালী ব্যাংক বন্দর শাখা থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। ১১ বছরে দুটি ব্যাংকের সুদ-আসলে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ঋণের বোঝা চেপেছে উত্তর কাট্টলীর ব্যবসায়ী শফিকুল আলমের ওপর। তার দাবি, ২০১১ সালে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক বন্ধকি সম্পত্তি নিলামের বিজ্ঞপ্তি দিলে বিষয়টি জানতে পারেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আগ্রাবাদের শেখ মুজিব রোডের মেসার্স এসএ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শফিকুল আলম নামে যে ব্যক্তিকে ৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, ওই ব্যক্তি আর কাট্টলীর শফিকুল ইসলাম এক নন।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালে সাউথইস্ট ব্যাংক চট্টগ্রামের একটি শাখা থেকে ৪০ লাখ টাকার ঋণ নেয় মেসার্স পাহাড়তলী এন্টারপ্রাইজ। এ ঋণ পেতে জমি বন্ধক রাখেন ঋণগ্রহীতা জাহাঙ্গীর কবির শহীদুল্লাহ। যদিও ঋণ গ্রহণের আগেই ওই জমি আব্দুস সালাম নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন জাহাঙ্গীর। বিক্রি করা জমির ভুয়া আমমোক্তারনামা দেখিয়ে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেন তিনি। এ ঘটনায় ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, শৃঙ্খলা না থাকার কারণেই মূলত এমনটা ঘটেছে। ঋণ দেয়ার জন্য এক গ্রাহকের পেছনে একসময় একাধিক ব্যাংক ছুটেছে। অনেক ঋণের ক্ষেত্রেই সে সময় নিয়ম মানা হয়নি। তবে এখন ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্ক।
Discussion about this post