প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালকদের বড় অংশ দেশের বাইরে অবস্থান করায় অনেক সময় বিকল্প পরিচালকরাই ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় অংশ নেন। এ সুযোগে বহিরাগতরাও ব্যাংকটির পর্ষদে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি চেয়ারম্যানকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
জানা গেছে, নিয়ম ভেঙে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পর্ষদ সভায় অংশ নিচ্ছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শহীদুল আহসান। শুধু তা-ই নয়, তিনি সভায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকাও রাখছেন। এভাবেই পর্ষদ সভায় পাস হচ্ছে বড় অঙ্কের ঋণ প্রস্তাব। তার প্রতিষ্ঠানের ঋণও পাস হয়েছে একই প্রক্রিয়ায়। এতে আমানতকারীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করেছেন ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন পরিচালক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ফরাছত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পর্ষদের সভায় অনেক সময় বহিরাগতরাও অংশ নিচ্ছেন, এটা সত্য। অনেক সময় মূল পরিচালকের পাশাপাশি বিকল্প পরিচালকও অংশগ্রহণ করছেন। আমি আগামী পর্ষদ সভায় এ বিষয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব, যাতে এমনটা আর না হয়।’
তবে পর্ষদ সভায় শহীদুল আহসানের অংশ নেয়াকে অন্যায় বলে মনে করেন না তিনি। বিষয়টি সম্পর্কে তার বক্তব্য হলো— ‘অনেক সময় আমরাও ব্যাংক পরিচালনায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে শহীদুল আহসানকে পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাই। এটাকে আমি খুব বড় অন্যায় মনে করি না।’
এদিকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও হট্টগোল নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিচালকরা একে অন্যকে প্রাণনাশের হুমকিও দিচ্ছেন। গত ২০ ডিসেম্বরের বোর্ডসভায় একজন পরিচালক ব্যাংক চেয়ারম্যানকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন বলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজে ই-মেইলের মাধ্যমে অন্য পরিচালকদের জানিয়েছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে কিনা, তা জানতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একজন আইনজীবীর মতামত নেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া একজন ব্যাংক কর্মকর্তা পরিচালনা পর্ষদকে বিভক্ত করছেন বলেও অভিযোগ আনেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। ব্যাংকটির একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের পুনর্নিয়োগকে কেন্দ্র করেও পরিচালনা পর্ষদে বিভক্তি লক্ষ করা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার পরিচালক, বিকল্প পরিচালক হতে পারবেন না। পরিচালক হওয়ার সময় এ রকম ঘোষণা দিয়েছেন মো. শহীদুল আহসানও। তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সময় ঘোষণা দেন যে, ‘আমি অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নই।’ এর পরও তিনি নিয়ম ভেঙে অন্য ব্যাংকের পর্ষদের সভায় প্রায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা হলো— এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। এর পরও নির্দেশনা লঙ্ঘন করে কেউ পর্ষদ সভায় অংশ নিলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, শহীদুল আহসান একদিকে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের বোর্ডসভায় যোগদান করে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে ভূমিকা রাখছেন, অন্যদিকে ব্যাংকটির একজন গ্রাহকও তিনি। ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদুল আহসানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেগমগঞ্জ ফিড মিলস লিমিটেডের অনুকূলে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১৮ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হয়। অভিযোগ উঠেছে, এ ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যাংকের বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত মানা হয়নি। এর আগে ২০১৩ সালে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর শহীদুল আহসানের মালিকানাধীন অন্য এক প্রতিষ্ঠান এজি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকেও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক বড় অঙ্কের অর্থায়ন করে। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই সেই ঋণ ফিরিয়ে আনা হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ৬ জুন অনুষ্ঠিত ৩২তম বোর্ডসভায় শহীদুল আহসানের মালিকানাধীন ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৪৮ কোটি টাকার কম্পোজিট ঋণ অনুমোদন করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সময় বোর্ডসভায় শহীদুল আহসান উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে এ ঋণ বিতরণ না করার জন্য স্বয়ং ব্যাংকের চেয়ারম্যানই এক চিঠিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানিয়েছিলেন। তবে বোর্ডসভার কার্যবিবরণীতে কারসাজি করে ওই ঋণ বিতরণ করা হয় বলে জানান বিকল্প পরিচালক এএম সাইদুর রহমান।
২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিকল্প পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনকালে বিকল্প পরিচালকের নিজের নামে কিংবা তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনোরূপ ঋণসুবিধা প্রদান করা যাবে না। পূর্বে প্রদত্ত ঋণসুবিধার মেয়াদ বা সীমা বৃদ্ধি করা যাবে না। কোনো মওকুফ বা সুদারোপ রহিতকরণ সুবিধাও দেয়া যাবে না। তা সত্ত্বেও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পর্ষদ সভায় অংশ নিয়ে যাচ্ছেন শহীদুল আহসান। সে সঙ্গে নিজ প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনুমোদনেও ভূমিকা রাখছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. শহীদুল আহসান বলেন, ‘ওই ব্যাংকের বোর্ডের সভার উপস্থিতি পত্রে কি আমার নাম আছে? তবে সর্বোচ্চ একদিন-দুদিন আমি পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণ করেছি। তারাই আমাকে ডেকেছিল, কারণ আমার ঋণের প্রস্তাব ছিল।’
বহিরাগতদের উপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীও। তিনি গত ১১ অক্টোবর ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ফরাছত আলীর কাছে লিখিত এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘ব্যাংকের পর্ষদ সভায় বেআইনিভাবে কিছু বহিরাগত, অন্যান্য উদ্যোক্তা এমনকি উদ্যোক্তা পরিচালকদের আত্মীয়স্বজনও অংশগ্রহণ করছেন। বহিরাগতরা ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করছেন, যাদের অনেকেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ রয়েছে।’
চিঠিতে এসব বহিরাগত কীভাবে বোর্ডসভায় অংশগ্রহণ করছেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে তার কারণও জানতে চান তিনি। এছাড়া কিছু পরিচালক ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় চাপ তৈরি করছেন বলেও তিনি চিঠিতে জানিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিচালক বিদেশে অবস্থান করছেন। এদের অনুপস্থিতিতে বিকল্প পরিচালকরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তবে বিকল্প পরিচালকরা আইন অনুযায়ী নির্বাচিত নন বলেও একই চিঠিতে মতামত ব্যক্ত করেন ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী।
ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজু ও বিকল্প পরিচালক এএম সাইদুর রহমানও বোর্ডসভায় বহিরাগতদের উপস্থিতি নিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
এদিকে বিদেশে অবস্থানের কারণে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণ না করলেও তাদের উপস্থিতি দেখানোর অভিযোগ এনেছেন একাধিক পরিচালক। বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের অভিযোগও এনেছেন তারা। গত ২০ জানুয়ারি অডিট কমিটির চেয়ারম্যান বরাবর এক চিঠিতে একজন পরিচালক জানান, ব্যাংকের ৩৯তম বোর্ডসভায় গৃহনির্মাণ বাবদ ৫৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের কোনো প্রস্তাব কার্যবিবরণীতে ছিল না। তবে ওই বোর্ডসভার পর ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে গৃহনির্মাণ ঋণ বাবদ ৫৭ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ওই ঋণ বোর্ডসভার অনুমোদন নিয়েই বিতরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পর্ষদ সভায় বহিরাগতদের অংশ নেয়ার ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়ে।
Discussion about this post