৪২ বছরে পদার্পণ করেছে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক আইএফআইসি। ১৯৭৬ সালে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর যাত্রা। ১৯৮৩ সালে সরকার এটিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন দেয়। ব্যাংকটির ব্যবসাকৌশল, সার্বিক অবস্থা এবং এ খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব

প্রথম আলো: ৪১ বছর পূর্ণ করল আইএফআইসি ব্যাংক। এই সময়ে ব্যবসায় ক্ষেত্রে কোন মডেলকে অনুসরণ করছে ব্যাংক?
শাহ আলম সারওয়ার: আমাদের ব্যবসার মডেল হলো ঝুঁকি বিকেন্দ্রীকরণ করে বেশি মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানো। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি হবে এসএমই ও মর্টগেজ-ভিত্তিক অর্থায়নের ওপর। ঋণের ঝুঁকিকে বৈচিত্র্যকরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বড় আমানতের চেয়ে ছোট ছোট আমানতের দিকে লক্ষ রেখে ব্যাংক এগোচ্ছে। ব্যাংক পরিচালনায় মডেল হলো কম স্বাচ্ছন্দ্যে ও কম সময়ে সেবা পৌঁছানো। দেশের বেশির ভাগ গ্রাহক ছোট সেবা নেয়। কম খরচে বেশি মানুষের সেবা পৌঁছানোই এখন প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রথম আলো: সহজে সেবা দিতে কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
শাহ সারওয়ার: ব্যাংকের কাঠামো ঠিক করা হচ্ছে। প্রতিটি কাজকে লক্ষ রেখে যোগ্য ব্যক্তিকে পদায়ন করা হচ্ছে। ব্যাংকে নতুন জনবল নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখা, আগের কর্মীদের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ দেওয়া আমাদের লক্ষ্য। এর সঙ্গে প্রতিটি পদের জবাবদিহি কী, তা ঠিক করা হচ্ছে। যাঁরা ভালো করছেন, তাঁদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আমরা ব্যাংকের প্রতিটি সেবাকে মূল্যায়ন করে গ্রাহকবান্ধব ও ঝুঁকিমুক্ত করেছি। সেবা ও সর্বোচ্চ মানের প্রযুক্তিকে একত্র করে সেবা দেওয়া হচ্ছে। একজন গ্রাহককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কত স্বাচ্ছন্দ্যে ও কম সময়ে সেবা দেওয়া যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে।
প্রথম আলো: এ জন্য নতুন কী ধরনের সেবা ও পণ্য চালু করা হয়েছে?
শাহ সারওয়ার: কম সুদে গৃহঋণ বা হোম লোন প্রকল্পে আমরাই পথিকৃৎ। এরপর অন্য ব্যাংকগুলো ওদিকে ঝুঁকেছে। এ খাতে আমরা ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছি। সব শাখা ব্যবস্থাপনাকে এমনভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যাতে সহজেই এ সেবা দেওয়া যায়। একজন গ্রাহক সাধারণত ২১ ধরনের সেবা নিতে ব্যাংকে আসেন। আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছি। ব্যাংকের যেকোনো কর্মকর্তা যাতে ওই ২১ ধরনের সেবা দিতে পারেন, তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বছর আড়াই হাজার কর্মকর্তার জন্য পাঁচ হাজার প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠান করা হয়েছে। ৫০ জনকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এখন সাধারণ সেবা, ঋণপত্র খোলা সেবা একজন কর্মকর্তাই দিতে পারেন। পৃথক ব্যক্তির কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সেবা নিতে কয়েকটি হিসাব খুলতে হয়। আইএফআইসি ব্যাংক ‘আমার অ্যাকাউন্ট’ নামে একটা নতুন সেবা চালু করেছে। ওই হিসাবে সব ধরনের সেবা পাওয়া যাচ্ছে। আমানত, ঋণ, কার্ড সেবা—সবই মিলবে এ হিসাবে। এক বছরে আমার অ্যাকাউন্ট হিসাব খুলেছেন ৭২ হাজার ব্যক্তি। ব্যাংকের প্রথম ৩৬ বছরে হিসাব ছিল দেড় লাখ, আর এক বছরেই ৭২ হাজার হিসাব খোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের গ্রাহক ৬ লাখ। ৫ বছরে ব্যাংকের গ্রাহক বেড়েছে তিন গুণ। এর মাধ্যমেই বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে।
প্রথম আলো: আপনি বলছেন, আইএফআইসি ব্যাংক ভালো চলছে, আরও উন্নয়নে নতুন অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে?
শাহ সারওয়ার: ঋণ খারাপ হয়ে যাওয়া আলাদা একটা বিষয়। এ জন্য কোনো পক্ষকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। ঋণ খারাপের জন্য অনেকগুলো বিষয় দায়ী। আমাদের দেশে ঋণদাতা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষা নেই। শুধু আইনি সুরক্ষা পাচ্ছি না, তা নয়। একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে প্রক্রিয়ায় ঋণগ্রহীতা বাছাই করা হয়, তার শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশে হয়নি। ক্রেডিট রেটিং, বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক প্রতিবেদন, আগের ঋণের হিসাব, আনুষ্ঠানিক টিআইএন নম্বর—এর কোনোটাই বাংলাদেশে নেই। আমরা যারা ঋণের যাচাই করি, তাতেই বড় গলদ থাকছে। ঋণ ব্যবস্থাপনার মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব দেখা যাচ্ছে। গ্রাহকেরা ঋণ অন্য খাতে ব্যবহার করছেন, সেটা ফিরিয়ে আনার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ঋণ খারাপ হলে তা আদায় করার ব্যবস্থা দেশে নেই। দেশে যথাযথ দেউলিয়া আইন আছে কি না, এটা বড় প্রশ্ন।
প্রথম আলো: তার মানে ব্যাংকগুলো কি প্রকল্প ঋণের জন্য প্রস্তুত নয়।
শাহ সারওয়ার: চাহিদা অনুযায়ী দেশে আর্থিক খাতের উন্নয়ন হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করতে হলে তার পুঁজি আসতে হয় পুঁজিবাজার অথবা ব্যক্তি থেকে। বাংলাদেশে এ দুই জায়গাতেই বড় ঘাটতি রয়েছে। ফলে একজন গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার শুরু থেকেই নানা ঘাটতি থাকে, অনেকের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজস্ব পুঁজি থাকে না। দেশে অর্থায়নের ক্ষেত্রে কাঠামোগত সমস্যা আছে। আমরা হলাম বাণিজ্যিক ব্যাংক, অথচ সবার প্রত্যাশা আমরা সব ধরনের ঋণ দেব। দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ দেওয়ার জন্য কিন্তু আমরা প্রস্তুত নয়। কারণ, আমরা গ্রাহক থেকে সঞ্চয়ী আমানত নিয়ে থাকি। আমাদের তো দীর্ঘমেয়াদি আমানত নেই। এক-দুই বছর মেয়াদি আমানত নিয়ে ১০ বছর মেয়াদি ঋণ দিতে হয়। এর চেয়ে কম সময়ে কোনো প্রকল্প দাঁড়াতে পারে না।
এর সমাধান হলো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান, গ্রহীতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা মিলে সামগ্রিক সমন্বয় করতে হবে। সমস্যাগুলো এক অপরের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান আনতে হবে। না হলে একজন অন্যকে দায়ী করতে থাকবে, কোনো সুরাহা হবে না।
প্রথম আলো: ব্যাংকগুলো মানবসম্পদ উন্নয়ন করছে না। প্রায়ই কর্মী নিয়ে টানাটানি করতে দেখা যাচ্ছে। এর সুরাহা কী?
শাহ সারওয়ার: যেকোনো প্রতিষ্ঠান যদি নিজেকে বড় করতে চায়, ভালো রাখতে চায়, তবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করতে হবে। স্বচ্ছ নিয়োগ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ—এসব থাকতে হবে। তাহলেই যেকোনো প্রতিষ্ঠান ভালো হয়ে উঠবে। না হলে স্থায়ী রূপ দেওয়া সম্ভব হবে না। কোনো ব্যাংক যদি অন্য ব্যাংক থেকে এক শ কর্মী নিয়ে যায়, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ, আগের কর্মীদের সঙ্গে হঠাৎ যোগ দেওয়া কর্মীদের একটা সমস্যা দেখা দেবে। এটা সামলাতে সামলাতে দিন চলে যাবে। এ ধরনের চর্চা বন্ধ হওয়া উচিত। আইএফআইসি ব্যাংক ৪১ বছরের প্রতিষ্ঠান। পুরোনো আমলের কর্মী নিয়েও আমাদের চলতে হচ্ছে। তাঁদের প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখা হচ্ছে।
প্রথম আলো: আমদানি বাড়ছে অথচ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কারণটা কী?
শাহ সারওয়ার: বাংলাদেশের কর্মীরা যেসব দেশে কাজ করেন, ওই কাজ অন্য দেশের কর্মী দিয়ে করানো কঠিন। আমার মনে হয়, বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স আসার আশঙ্কা আছে। যেসব ব্যাংক মধ্যপ্রাচ্য থেকে অল্প অল্প রেমিট্যান্স আনত, তা-ও কমে গেছে। আমাদের ওমানের রেমিট্যান্স হাউসও একই সমস্যায় পড়েছে। প্রবাসীদের আয় যেভাবে কমার কথা বলা হচ্ছে, সেভাবে কমেনি। অন্য মাধ্যমে তাঁরা টাকা পাঠাচ্ছেন। আগে হুন্ডি করতে বাড়িতে বাড়িতে টাকা নিয়ে যেতে হতো, এখন তা লাগছে না। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজেই তা পৌঁছে যাচ্ছে।
Discussion about this post