দোষীদের আড়াল করতে কৌশলী পন্থা অবলম্বন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এক থেকে তিন বছর আগে নিয়ম ভেঙে দেয়া বেশির ভাগ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এতে নিরাপদেই থাকছেন দোষী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গ্রাহকও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে অনিয়মকৃত ঋণের বেশির ভাগই অবলোপন করার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চিঠি দেয়া হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকেও গত ২৩ অক্টোবর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম সার্কেলের মহাব্যবস্থাপকের কাছে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম সার্কেলের মহাব্যবস্থাপক মো. কামরুজ্জামানের সঙ্গে গতকাল যোগাযোগ করা হলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সার্কেল তো কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। ব্যাংকের সারা দেশের কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে প্রধান কার্যালয়। কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে প্রধান কার্যালয়কেই নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন ও বণিক বার্তার নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ’১২ সাল পর্যন্ত যে পরিচালনা পর্ষদ এসব ঋণ অনুমোদন করেছিল, তারাই আবার তা অবলোপন করেছে। এ ঋণ বিতরণ ও অবলোপনের পেছনে সক্রিয় রয়েছে বড় একটি সিন্ডিকেট। এছাড়া ব্যাংক কর্তৃপক্ষও ঋণ আদায়ে উল্লেখ করার মতো কোনো তত্পরতা দেখায়নি।
যোগাযোগ করা হলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘এসব অর্থ সহজে আদায় হবে না। এটা বোঝার পর আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে তা অবলোপন করেছি।’
জানা গেছে, চট্টগ্রামভিত্তিক নূরজাহান গ্রুপের মালিকানাধীন মেসার্স নূরজাহান সুপার অয়েলের ৬৫ কোটি, মাররীন ভেজিটেবল অয়েলের ৩০৬ কোটি, তাসমিন ফ্লাওয়ারের ২৭ কোটি ও জাসমীর ভেজিটেবলের ৮৬ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। আর খালেক অ্যান্ড সন্সের ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ২০৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই চট্টগ্রামে ব্যাংকের পাঁচটি শাখা থেকে এ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। ২০১১ ও ’১২ সালে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একক ঋণগ্রহীতা সীমা অতিক্রম করলেও তার অনুমোদন নেয়া হয়নি।
একইভাবে লালদীঘি পূর্ব করপোরেট শাখায় আলহাজ হারুনুর রশীদের মালিকানাধীন মেসার্স চিটাগাং ইস্পাত ও রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েলের দায় ১৪৮ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ ২০১২ ও ’১৩ সালে ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকৃত হয়। তার পরও তড়িঘড়ি করে অবলোপন করা হয়েছে এ ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে ৯ হাজার ৯০৫টি হিসাবের বিপরীতে ১ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি শাখারই ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা, যা অবলোপনকৃত ঋণের ৯৩ শতাংশ। এসব ঋণের ক্ষেত্রে অনিয়ম থাকায় দ্রুত তা অবলোপন করা হয়েছে। যদিও ২০১২ সালের আর্থিক বিবরণীতে ব্যাংকটি বৃহৎ খেলাপি ঋণগুলো আদায়ের ক্ষেত্রে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু চট্টগ্রামের পাঁচটি শাখার ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা অবলোপনের মধ্য দিয়ে তা লঙ্ঘন হয়েছে।
পাঁচটি শাখার মধ্যে লালদীঘি পূর্ব করপোরেট শাখার ৫১৩ কোটি, আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার ৪১৭ কোটি, আসাদগঞ্জ করপোরেট শাখার ১৪৫ কোটি, নিউমার্কেট করপোরেট শাখার ২৭৯ কোটি ও বাণিজ্যিক এলাকা করপোরেট শাখার ১১৯ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্বে) আরস্তু খান বলেন, দ্রুততম সময়ে ঋণের সীমা বাড়িয়ে চট্টগ্রামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অর্থ বের করে নিয়েছে। এগুলো বিশেষ বিবেচনায় অবলোপন করা হয়েছে। তবে অবলোপন মানেই তো ছেড়ে দেয়া নয়। মামলা হয়েছে। নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে অর্থ আদায়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে সবচেয়ে পুরনো ঋণ অবলোপনের নির্দেশনা থাকলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যেগুলো অবলোপন করেছে, তার বেশির ভাগই ২০১১ ও ’১২ সালে বিতরণ করা। ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিজনক পুরনো ঋণ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম সময় ধরে ক্ষতিজনক মানে থাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের পারস্পরিক যোগসাজশে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পরিদর্শনে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রেও অসামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছে। পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০০টি হিসাবের বিপরীতে ২ হাজার ৬৫৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এতে অনেক অসামঞ্জস্য রয়েছে। বকেয়া কিস্তি, মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তি এবং আদায় করা কিস্তি ও পরিমাণ সঠিক নয় বলে মনে করছে পরিদর্শক দল। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের কিস্তি পুনঃ পুনঃ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা অশ্রেণীকৃত রেখে দিয়েছে, যা বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৫/২০১২-এর নির্দেশনার পরিপন্থী।
প্রতিবেদনে পরিদর্শন তারিখ পর্যন্ত ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ১ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) শর্ত মোতাবেক এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে সমর্থ হয়নি ব্যাংকটি। এসব খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে পরিদর্শন প্রতিবেদনে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করেছে, পরিদর্শন তারিখ পর্যন্ত ব্যাংক কর্তৃক দায়েরকৃত পাঁচ বছরের কম সময়কাল ধরে মামলাধীন ঋণসংখ্যা ২ হাজার ৭৮৯। এর বিপরীতে মোট বকেয়ার পরিমাণ ৩ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। আর পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে মামলাধীন ঋণসংখ্যা ৩ হাজার ৮০২, যার বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্তৃক ও ব্যাংকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে মামলা তদারকি জোরদার করতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
Discussion about this post