২০১৯ সালে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিশেষ পরিদর্শনে উঠে আসে, আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে মাটির তৈরি টেরাকোটা টাইলস রপ্তানি করেছে এসবি এক্সিম নামের ঝিনাইদহের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেই রপ্তানির বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা এখনো দেশে আসেনি। অথচ ওই রপ্তানি বিল কিনে প্রতিষ্ঠানটিকে ১৯০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এখন সেই টাকা ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংক।
বিদেশি যেসব ব্যাংক থেকে রপ্তানি আদেশ এসেছিল, তার চারটিরই নিজ দেশে কার্যক্রম নেই, পরিচালনার অনুমোদনও নেই। বৈশ্বিক ভাষায় এসব ব্যাংক ‘শেল ব্যাংক’ নামে পরিচিত। এসব ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে বৈশ্বিক ও দেশীয় নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। ফলে আদৌ কোনো টাইলস রপ্তানি হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্ন রয়েই গেছে।
দেশ থেকে রপ্তানি করে ও বিদেশ থেকে রপ্তানি আদেশ দিয়ে লোপাট করা অর্থের সুবিধাভোগী গ্রাহক এই শাহজাহান বাবলু। এসবি পুণ্য গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনি। শাহজাহান বাবলু (এসবি) ও তাঁর মেয়ে শামসুন ফারিয়া পুণ্যের নামেই এ ‘এসবি পুণ্য’। এ ছাড়া ‘এসবি এক্সিম’ নামেও ব্যবসা করেন শাহজাহান বাবলু।
টাইলসের পাশাপাশি কৃষি খাতের কীটনাশক ও সার আমদানির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত শাহজাহান। ২০১৯ সালে অর্থ পাচারের ঘটনা ধরা পড়ার পর তাঁর টেরাকোটা টাইলসের উৎপাদন বন্ধ। আর শাহজাহান বাবলুও দেশছাড়া। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে সীমিত আকারে সার আমদানি চলছে বলে জানিয়েছেন কমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
দুবাই ও সিঙ্গাপুরে যত ব্যবসা
এসবি পুণ্য গ্রুপের ওয়েবসাইটটি বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। যখন খোলা ছিল, তখন গ্রুপটি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে পাঁচ ধরনের ব্যবসা রয়েছে। এর মধ্যে দুবাইয়ে রয়েছে পুণ্য জুয়েলারি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে পুণ্য ফুড স্টাফ ট্রেডিং ও পুণ্য জেনারেল ট্রেডিং। আর সিঙ্গাপুরে রয়েছে পুণ্য গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড পিটিই ও পুণ্য সুপারমার্কেট পিটিই লিমিটেড।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরের বিজনেস ডিরেক্টরি ঘেঁটে দেখা গেছে, পুণ্য গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড ২০১৮ সালের ২ আগস্ট সিঙ্গাপুরের ব্যবসার জন্য নিবন্ধন নেয়। আর পুণ্য সুপারমার্কেটের নিবন্ধন নেওয়া হয় ২০১৭ সালের ৩ মার্চ। দুটিরই ঠিকানা দেশটির গে লেং এলাকার গ্র্যান্ড ভিউ সুইটস। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত দেশের যে কয়টা প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, সেই তালিকায় এসবি গ্রুপ ও তার সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম নেই।
শাহজাহান বাবলু সম্প্রতি তাঁর ফেসবুকে বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করেছেন। এসব ছবির অবস্থান অনুযায়ী, দুবাইয়ের জুমেইরাহ এলাকায় তাঁর বাড়ি। বাড়ির সুইমিং পুলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের ছবি তুলেছেন। ফেসবুকে ছবির ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘এট মাই হাউস, জুমেইরাহ, ইউএই।’
দুবাইয়ের বাড়ি ও ফ্ল্যাট বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহজাহান বাবলু যে ধরনের বাড়ির ছবি প্রকাশ করেছেন, জুমেইরাহ এলাকায় এ ধরনের একেকটি বাড়ির মূল্য প্রায় ৪ কোটি দিরহাম। প্রতি দিরহামের বিনিময় মূল্য ২৩ টাকা ধরে হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৯২ কোটি টাকা।
গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত শাহজাহান বাবলুর পোস্ট করা বাড়ির ছবিতে সব মিলিয়ে এক হাজারের বেশি মন্তব্য-পাল্টামন্তব্য রয়েছে।
অপর একটি ছবিতে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয় তুলে ধরে লিখেছেন এটি দুবাইয়ে। ছবির পেছনে পুণ্য জুয়েলারি, পুণ্য জেনারেল ট্রেডিং ও এস পুণ্য ফুডস্টাফ ট্রেডিংয়ের সাইনবোর্ড। অন্য একটি ছবিতে স্ত্রী সুরাইয়া শাহজাহানও রয়েছেন।
বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন ও সার্বিক বিষয়ে জানতে শাহজাহান বাবলুর মোবাইলে ফোনে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। হোয়াটস অ্যাপেও একাধিকবার খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তবে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বহাল তবিয়তে অভিযুক্তরা
টেরাকোটা টাইলস রপ্তানির নামে টাকা পাচারের ঘটনার পরও শুধু শাহজাহান বাবলু বহাল তবিয়তে রয়েছেন, তেমনটি নয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত কমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আর কিউ এম ফোরকান, বর্তমান উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কাজী রিয়াজুল করিমসহ ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ের ১১ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল কমার্স ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে সবার বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে ব্যাংকটি। এ ঘটনায় অভিযুক্ত অন্যরা হলেন ব্যাংকটির ট্রেজারি বিভাগের প্রধান মো. কামরুজ্জামান, প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক আফজাল হোসেন, দিলকুশা শাখার ব্যবস্থাপক ফকির নাজমুল আলম ও অপারেশন ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ শাখার ব্যবস্থাপক হাসান ফারুক, ঢাকার মৌলভীবাজার শাখার অপারেশন ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম, প্রধান কার্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহিনুজ্জামান ও ফারহানা রাজ্জাক এবং জামাল হোসেন। টাইলস রপ্তানির নামে অর্থ পাচারের সময় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের সবাই ব্যাংকটির দিলকুশা শাখা ও প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে আসামি বলা যাবে না। তাই ব্যাংকের কেউ এ ঘটনায় জড়িত ছিল, এটা বলার সময় আসেনি। শাহজাহান বাবলুর প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল। অনেক দিন হয়ে গেছে। এখনো অনুমোদন মেলেনি।’
ওমর ফারুক এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানার একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহক বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার করে বিদেশে বসে কেউ আয়েশ করবে, এটা কখনো কাম্য হতে পারে না। অপরাধী যেখানেই থাক না কেন, তাকে ফিরিয়ে এনে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক এসব বিষয় আরও গভীরভাবে দেখতে পারে। আর ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা এতে সহায়তা করেছেন, তাঁদেরও শাস্তির আওতায় আনা উচিত।’
Discussion about this post