২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল তফসিলভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা করে বেসরকারি খাতের দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড। এর পর তিন বছরও হয়নি। এর মধ্যেই প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মে জড়িয়েছে ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে উঠে এসেছে অনিয়মের এ চিত্র। এজন্য দায়ী করা হয়েছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানকে। ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তথ্যমতে, শাখা কর্তৃক যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে ঋণ আবেদন। প্রধান কার্যালয়ও কোনো ধরনের যাচাই ছাড়াই তা পর্ষদে উত্থাপন করেছে। পরে অনুমোদনও হয়েছে ওই ঋণ। ঋণ অনুমোদনের আগেই গ্রাহককে ‘সাময়িক অনুমোদনপত্র’ দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যদিও যথাযথ ব্যবহার হয়নি অনুমোদিত এ ঋণের। এসব অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির তিন শাখা গুলশান, মতিঝিল ও শ্যামপুরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির গুলশান শাখায় রম অ্যান্ড হাস এন্টারপ্রাইজের ঋণসীমা ২০১৫ সালের প্রথম চার মাসে দুই দফা বাড়ানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি ঋণ আবেদন করলে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই গুলশান শাখা তা প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়। পর্ষদে অনুমোদনের পর এ ঋণের অর্থে পরিশোধ করা হয় ফিনিক্স ফিন্যান্সে এমএনএইচ বুলুর ৮ কোটি টাকার দায়। রম অ্যান্ড হাসের কর্ণধার সামিউল্লাহ বাবুর নাম থাকলেও জামানত হিসেবে এমএনএইচ বুলু ও তার মেয়ে নওশিন লায়লার সম্পদ দেখানো হয়। এতে প্রমাণ মেলে, রম অ্যান্ড হাস এন্টারপ্রাইজ মূলত ভুয়া প্রতিষ্ঠান। ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী এমএনএইচ বুলু।
একই শাখা থেকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শাহাবুদ্দীন আলমের লায়লা বনস্পতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ৩০ কোটি টাকা কম্পোজিট ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। যদিও এর বিপরীতে জামানত ছিল ৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক দেনা ছিল ৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৮২ কোটি টাকায় আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল। ঝুঁকির বিষয়টি এড়িয়েই প্রতিষ্ঠানটিকে সুুবিধা দেয়া হয়েছে। ঋণ অনুমোদনের আগেই ‘সাময়িক অনুমোদনপত্র’ দেয়া হয় গ্রাহককে।
গুলশান শাখা থেকে ৩০ কোটি টাকার কম্পোজিট ঋণ সুবিধা দেয়া হয় এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক কানিজ ফারজানা রাশেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনকে। যদিও এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ ও ইকুইটি ছিল যথাক্রমে ২ কোটি ৬৪ লাখ ও ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটিকে ইকুইটির প্রায় ১২ গুণ ঋণ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে আমানতকারীদের স্বার্থ ঝুঁকিতে ফেলা হয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফারমার্স ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গুলশান শাখা থেকে এমারাল্ড ফুডকে দেয়া হয়েছে ১৭ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা; যা ব্যবহার হয়েছে অন্য খাতে। খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে শাবিজ ইন্টারন্যাশনালকে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, এসব উড়ো খবর। ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে এর বেশি বলতে চাননি তিনি।
ব্যাংকটির মতিঝিল শাখা থেকে ইবিএল সিকিউরিটিজকে দেয়া হয় ২০ কোটি টাকার ঋণ। এছাড়া প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজকে ঋণ দেয়া হয় ৫ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজকে ৫ কোটি ও কাজী সিকিউরিটিজকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যদিও ২০১৫ সালের ৩০ জুন ও ৩১ আগস্ট ঋণগ্রহীতার তালিকায় নাম নেই এসব প্রতিষ্ঠানের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে, পর্ষদের এক মেমোয় মতিঝিল, গুলশান ও ইমামগঞ্জ শাখার সাতটি সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৬৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ আবেদন প্রধান কার্যালয়ের ট্রেজারিতে স্থানান্তরের সুপারিশ করা হয়। ৩০ জুন পর্ষদের জরুরি সভায় তা অনুমোদন হলেও ২৯ জুন প্রধান কার্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ইবিএল সিকিউরিটিজ, প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজ, ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ, কাজী ইকুইটিজ, বিডি সিকিউরিটিজ ও ইউনিয়ন ক্যাপিটালে ঋণের স্থিতি ৩৮ কোটি ২৬ লাখ টাকাকে ঋণ এবং অগ্রিমে না দেখিয়ে বিনিয়োগ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অস্বাভাবিক গতিতে ঋণ বৃদ্ধির প্রকৃত চিত্র আড়াল করতেই ব্যাংকটি এ কৌশল বেছে নেয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে। এজন্য দায়ী করা হয়েছে ব্যাংকটির ট্রেজারিপ্রধান দীন মোহাম্মদ, ব্যবসাপ্রধান ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী, এএমডি একেএম শামীম ও এমডি চৌধুরী মোস্তাক আহমেদকে।
ব্যাংকটির মতিঝিল শাখা থেকে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক মেসার্স রুবেল ব্রাদার্সকে ৪ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়। একইভাবে সামসুল হক ভুঁইয়ার মালিকানাধীন খেলাপি প্রতিষ্ঠান এ্যাপোলা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনকে ২৫ কোটি, এ্যাপোলো ট্রেডকে সাড়ে ৫ কোটি, জান্নাত ফিলিংকে ২ কোটি টাকাসহ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ১২ কোটি টাকা দেয়া হয়; যা আবার ব্যবহার হয় বেসিক ব্যাংকের দায় পরিশোধে।
ফারমার্স ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক ও ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মোহাম্মদ খালেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রিনল্যান্ড টেকনোলজিকে ১০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। ট্রাক্টর আমদানির জন্য ঋণ নিলেও ব্যবহার করা হয়েছে অন্য ঋণ পরিশোধে। ব্যাংক পরিচালকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা দেয়া হলেও তা ব্যাংকের নির্ধারিত ছকে উল্লেখ করা হয়নি।
তথ্যমতে, যথাযথ অনুমোদন না নিয়েই মতিঝিল শাখা থেকে রনক এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয়েছে ১৩ কোটি ও আদুরি হাউজিংকে ২ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা। দ্রুততম সময়ে ও সীমাতিরিক্ত ঋণ দেয়া হয়েছে লাকি টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিজ, জিবেক ট্রেডিং, মেসার্স পাথর বিতান, মেক্সিল ফ্যাব্রিকস, স্পিড টেকনোলজিস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, হোটেল লেক ভিউ, ইমেক্সিন ট্রেডিং ও পুষ্প এন্টারপ্রাইজকে। এছাড়া ঋণ সুবিধা নিয়ে শাখার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখছে না এইচএম এন্টারপ্রাইজ, লেদার ফেয়ার, এলাইট টেকনোলজিস ও সেঞ্চুরি ভিউ।
ব্যাংকটির শ্যামপুর শাখা থেকে সাফা কমিউনিটি সেন্টারের অনুকূলে ৩ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া ইস্টওয়ে ফ্যাশনকে দেয়া হয় প্রায় ১১ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা। যদিও কারখানায় আমদানিকৃত বা সংগৃহীত পণ্যের মজুদ মেলেনি। এভাবে বিভিন্ন কৌশলে ব্যাংকটি থেকে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গেলেও মন্তব্য করতে রাজি হননি এএমডি একেএম শামীম ও এমডি চৌধুরী মোস্তাক আহমেদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, ব্যাংকটির সার্বিক অবস্থা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। কিছু অনিয়ম পাওয়া গেছে। গত ডিসেম্বরের তথ্যের ভিত্তিতে শিগগিরই আমরা ব্যবস্থা নেব।
Discussion about this post