মাহাবুবুল হক চিশতী ও মাজেদুল হক চিশতী। সম্পর্কে দুই ভাই। বাবুল চিশতী নামে পরিচিত মাহাবুবুল হক চিশতী ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালক। একই সঙ্গে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানও। শামীম চিশতী নামে পরিচিত মাজেদুল হক চিশতী একজন ব্যবসায়ী। বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিয়েছেন দ্য ওয়েল টেক্স, আবিদ ডায়িং মিলস লিমিটেড, ওয়েল সোয়েটার্স ও আনাম শকসের নামে।
নতুন অনুমোদন পাওয়া দ্য ফারমার্স ব্যাংকে সম্প্রতি যে অনিয়ম হয়েছে, তার দায় পড়েছে মাহাবুবুল হক চিশতীর ওপর। আর বেসিক ব্যাংকে যে ঋণ অনিয়ম হয়েছে, তাতে নাম এসেছে মাজেদুল হক চিশতীর। অর্থাৎ ফারমার্স ও বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন চিশতী পরিবারের এ দুই ভাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া গেছে; বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়েও যার সত্যতা মিলেছে।
সূত্রমতে, ফারমার্স ব্যাংকের মতিঝিল ও গুলশান করপোরেট শাখার ঋণ প্রদান করা হয় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতীর একক ক্ষমতায়। কোনো ধরনের দাফতরিক প্রক্রিয়া ছাড়াই মাহাবুবুল হক চিশতীর লিখিত নির্দেশে গুলশান শাখা থেকে সাইফ পাওয়ারটেককে আড়াই কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। পরে গ্রাহকের ঋণ ৪ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয় তারই মৌখিক নির্দেশনায়।
একইভাবে নির্বাহী কমিটির সভায় ঋণ প্রস্তাব উত্থাপন না করেই চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজকে ৫ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেয়া হয় ব্যাংকটির মতিঝিল শাখা থেকে। গুলশান শাখা থেকে ইউনাইটেড ব্রিকস ও ফুলতলা ফিলিং স্টেশনের ঋণ প্রস্তাব জমা দেয়ার আগেই গত বছরের ১০ মার্চ নির্বাহী কমিটির সভায় ৮ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এর পর ১০ মার্চ শাখা থেকে ঋণ আবেদনের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য দেয়া হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। একই শাখা থেকে আরবান ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ঋণ প্রস্তাব জমা দেয়ার আগেই ১৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। চিটাগং ফিশারিজকেও ১৮ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেয়া হয় ঋণ প্রস্তাব পাওয়ার আগেই।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত মাসে মাহাবুবুল হক চিশতীর কাছে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এসব অনিয়মের দায় আপনার ওপরই বর্তায়। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৬ ধারার আওতায় কেন আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার কারণ দর্শানোর জন্য বলা হলো।
মাহাবুবুল হক চিশতী এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। পরবর্তী পদক্ষেপ বিষয়ে এখন কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত এসব ঋণ আদায়ের দায়িত্ব তার ওপর পড়তে পারে বলে সূত্রগুলো বলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই ফারমার্স ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে আদ দ্বীন হাসপাতালকে ২০ কোটি, সিয়াম এন্টারপ্রাইজকে ৪ কোটি, এইচএম এন্টারপ্রাইজকে সাড়ে ৪ কোটি, শুভ্র এন্টারপ্রাইজকে সাড়ে ৮ কোটি, এনআর ট্রেডিংকে ৩ কোটি ও পাণ্ডুঘর লিমিটেডকে দেড় কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এজন্য ব্যাংকটির কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে ১৮৫ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেয়া হয় মাজেদুল হক চিশতীকে। দ্য ওয়েল টেক্স, আবিদ ডায়িং মিলস লিমিটেড, ওয়েল সোয়েটার্স ও আনাম শকসের নামে দেয়া হয় এসব ঋণ। চার প্রতিষ্ঠানকে ১৮৫ কোটি টাকার এ আর্থিক সুবিধার বিপরীতে মর্টগেজ রয়েছে মাত্র ৪২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব হিসাবের মাধ্যমে নিয়ম ভেঙে অর্থ গ্রহণের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। খেলাপি হয়ে গেলেও ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় তা না করে উল্টো শাখাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত না করার নির্দেশনা দেয়া হয়।
এ তথ্য পাওয়া যায় ব্যাংকটির দিলকুশা শাখার এক চিঠিতে। গত বছরের ৩১ মার্চ প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে দিলকুশা শাখা জানায়, ৩১ মার্চ ভিত্তিতে শাখার ঋণ শ্রেণীকৃত করা হয়েছে। তবে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি হিসাব খেলাপি হলেও তা নিয়মিত হিসেবে দেখানো হয়।
জানা গেছে, মাজেদুল হক চিশতী এর আগে একই প্রতিষ্ঠানের নামে প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব ঋণে অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। পরে তিনি প্রিমিয়ার ব্যাংক ছেড়ে বেসিক ব্যাংকে চলে আসেন। বেসিক ব্যাংকেও একই পথ অবলম্বন করেন। বেসিক ব্যাংকের তত্কালীন চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদেই সে সময় এ সুবিধা দেয়া হয় এ ব্যবসায়ীকে।
যোগাযোগ করা হলে মাজেদুল হক চিশতী গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কোনো অপরাধ করিনি। ব্যবসা ভালো না থাকার কারণে ঋণ পরিশোধ সম্ভব হয়নি। বর্তমানে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। তাছাড়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক খাতের ব্যবসা এখনো আশানুরূপ ভালো যাচ্ছে না।
জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চে বিশেষ বিবেচনায় এসব ঋণ নিয়মিত করেছেন মাজেদুল হক চিশতী। ব্যাংকটির দিলকুশা শাখার এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিশেষ সুবিধা পাওয়ার পর গ্রাহক ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে আইনি পদক্ষেপের ভয়ে তিনি সম্প্রতি যোগাযোগ করে ঋণটি নিয়মিত করেছেন। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক থেকে ঋণটি নিয়মিত রয়েছে।
এসব বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, একজন (মাহাবুবুল হক চিশতী) পরিচালক হিসেবে অন্যায় করেছেন। অন্যজন (মাজেদুল হক চিশতী) ঋণে অনিয়ম করেছেন। প্রচলিত বিধিবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিছু ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
Discussion about this post