নিয়ম ভেঙে বেসিক ব্যাংকের দেয়া ঋণ একের পর এক খেলাপি হয়ে পড়ছে। ফলে তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৫৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ বা ৬ হাজার ১৪৮ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো ব্যাংকগুলোর তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। সে সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল বিতরণ করা মোট ঋণের ২৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পরই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এখন বেসিক ব্যাংকের।
যোগাযোগ করা হলে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. মামুন আল-রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আলাদা গ্রুপ করে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি তাদের লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করে দেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক কতটা সফল হচ্ছে, তা প্রতি বৈঠকেই তদারক করা হচ্ছে।
নানা অনিয়মের কারণে বেসিক ব্যাংক নিয়ে এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ার পর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) অপসারণের পাশাপাশি নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে।
জানা গেছে, নতুন পর্ষদ ব্যাংকটির প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও ব্যাংকটির প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংকটির ১ কোটি টাকার উপরে দেয়া সব ঋণ এসএফ আহমেদ ও মেবস অ্যান্ড জে পার্টনারকে দিয়ে তদন্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে এগিয়ে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে আছে ইসলামী, জনতা, সোনালী, প্রাইম, অগ্রণী, পূবালী, মার্কেন্টাইল, সাউথইস্ট ও ইউসিবিএল।
তিন মাসে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৭৬ কোটি টাকা। জুন শেষে ব্যাংকটির ২ হাজার ১৯২ কোটি টাকা থাকলেও সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। ব্যাংকের কয়েকজন বড় গ্রাহক কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের কয়েকজন গ্রাহকের কিস্তি বকেয়া থাকায় খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর বাইরে ব্যাংকের বিনিয়োগ গুণগত মানে ভালো অবস্থায় আছে। তবে আক্ষরিক অর্থে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা এখনো ফেরেনি। ফলে ব্যবসায়ও গতি আসেনি। এ কারণে আগের মতোই খেলাপি হয়ে পড়ছেন অনেক ব্যবসায়ী।
তিন মাসে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪০৪ কোটি টাকা। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। ফলে ঋণের ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়মিত হওয়া কয়েকজন গ্রাহক আবারো খেলাপি হয়ে পড়েছেন। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন মাসে বেড়েছে ৪০০ কোটি টাকা। জুনে ব্যাংকটির ১০ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা খেলাপি থাকলেও সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা।
এদিকে বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন মাসে বেড়েছে ৩১০ কোটি টাকা। জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৯৫৬ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে হয়েছে ১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির ৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। মূলত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সঙ্গে দূরত্বের ফলে ব্যাংকটিতে এ অবস্থা দেখা দিয়েছে।
জুন শেষে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি বড় খেলাপি ঋণও তড়িঘড়ি অবলোপন করার চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনমতে, ২০১৩ সালে ৯ হাজার ৯০৫টি হিসাবের বিপরীতে ১ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি শাখারই ১ হাজার ২২২ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে, যা অবলোপনকৃত ঋণের ৯৩ শতাংশ। এসব ঋণের ক্ষেত্রে অনিয়ম ছিল। এ কারণে দ্রুতই অবলোপন করা হয়েছে।
পূবালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন মাসে বেড়েছে ২৫৬ কোটি টাকা। জুনে ব্যাংকটির ৭০৩ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি থাকলেও সেপ্টেস্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫৯ কোটি টাকা।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন মাসে বেড়েছে ২৪৮ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬২৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে, ঋণখেলাপি হওয়ার নত্ত্বেও ব্যাংকটির পরিচালক মো. আবদুল হান্নান বেনামে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা নিয়েছেন। এর পরও ব্যাংকটি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। পাশাপাশি ব্যাংকটির পরিচালকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে একটি পক্ষ গুলশান শাখাকে প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। যদিও এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি। এ ঘটনায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিলেও ব্যাংকটি তা পরিপালন করেনি। এসব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কেন্টাইল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে।
বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন মাসে ২১৮ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৬৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। একই সময়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২০০ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০৭৫ কোটি টাকায়।
এ প্রসঙ্গে ইউসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক চলছে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের মধ্যে। অনেক বড় ভালো গ্রাহকও ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে খেলাপি হয়ে পড়ছেন। ব্যবসা ভালো চলছে না। এ কারণে খেলাপি ঋণও প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এমএ তসলিম বলেন, ‘খেলাপি ঋণ এভাবে বেড়ে যাওয়ার অর্থ ব্যাংকিং খাত নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; পুরো অর্থনীতির জন্যই যা শঙ্কাজনক। এভাবে ব্যাংকের ক্ষয় হলে খাতটি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়বে। যারা খাতটিকে দুর্বল করছেন, তারাই আবার প্রণোদনা পাচ্ছেন। সরকারি ব্যাংকগুলোকে আমাদের অর্থে মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে। এভাবে বেশি দিন চললে সামনে দুর্দিন আছে।’
তিনি আরো বলেন, ব্যাংকাররা বলছেন বিনিয়োগ নেই, রফতানিও কমে গেছে। এর পর আবার মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে। কোথায় যাচ্ছে এসব অর্থ, তা প্রশ্নবিদ্ধ। আবার যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। এর ওপর ভিত্তি করে যে নীতিমালা তৈরি হয়, তা টেকসই হবে না।
Discussion about this post