অব্যাহতভাবে কমছে জ্বালানি তেলের দাম। এতে দুর্বল হচ্ছে জ্বালানি তেলনির্ভর দেশগুলোর অর্থনীতি। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের অন্যতম উত্স সৌদি আরবের অবস্থাও। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সিঙ্গাপুরে প্রবাসী শ্রমিকদের ঘিরে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ। এসবেরই প্রভাব পড়ছে দেশের রেমিট্যান্স আয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে রেমিট্যান্সপ্রবাহে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬৮ শতাংশে।
গত বছর রেমিট্যান্স আয়ের নিম্নপ্রবৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে নয়টি দেশ থেকে রেমিট্যান্স কমে যাওয়া। রেমিট্যান্স কমার তালিকায় থাকা দেশগুলো হলো— সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ব্রুনাই, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, লিবিয়া, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও ভারত। এছাড়া সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহে প্রবৃদ্ধি হলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, বিভিন্ন দেশে জীবনযাপন ব্যয় বেড়ে গেছে। পাশাপাশি অস্থিরতাও চলছে অনেক দেশে। এছাড়া মুদ্রা পাচার রোধে আইনও অনেক কড়াকড়ি হয়েছে। ফলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠাতে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ঘোষিত আয়ের বাইরে অন্য আয় দেশে আনা যাচ্ছে না। সোনালী ব্যাংক ইউকের মাধ্যমেও একই কারণে রেমিট্যান্স কম এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২০১৪ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৭৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৭৬ কোটি ১৫ লাখ ডলারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া থেকেও কমেছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ। ২০১৪ সালে দেশটিতে অবস্থানরত প্রবাসীরা ৫ কোটি ৬৪ লাখ ডলার দেশে পাঠালেও গত বছর পাঠিয়েছেন ৩ কোটি ২৫ লাখ ডলার।
লিবিয়া ফেরত প্রবাসী ডা. মোশাররফ হোসেন বলেন, যুদ্ধের আগে বাংলাদেশী মুদ্রায় বেতন পেতাম সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এখন তা এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। মূলত লিবিয়ার দিনারের অবমূল্যায়নের ফলেই এমনটি হয়েছে।
গত বছর রেমিট্যান্স কমেছে আরেক গুরুত্বপূর্ণ উত্স দেশ কুয়েত থেকেও। ২০১৪ সালে দেশটিতে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১১০ কোটি ডলার দেশে পাঠালেও গত বছর পাঠিয়েছেন ১০৫ কোটি ২৫ লাখ ডলার। জ্বালানি তেলের নিম্নমূল্যের প্রভাব পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতেও।
যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত ছাত্রদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় দেশে ফিরতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া অবৈধভাবে থাকা প্রবাসীরা চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব কারণে দেশটি থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমছে। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা ৮৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার দেশে পাঠালেও গত বছর পাঠিয়েছেন ৮৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী আলমগীর হোসেন বলেন, এ দেশে অবৈধভাবে থাকা যায় না। প্রয়োজনীয় নথিপত্র ছাড়া কেউ চাকরি দিলে মালিককে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়। ফলে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশীরা চাকরি না পেয়ে ফ্রান্স, ইতালিতে পাড়ি জমাচ্ছেন। অনেকে দেশেও ফিরে যাচ্ছেন।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশগুলো থেকেও প্রবৃদ্ধি সেভাবে হচ্ছে না। সৌদি আরব থেকে ২০১৪ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩২৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত বছর তা কিছুটা বাড়লেও ৩২৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এর কারণ হিসেবে দেশটির অর্থনীতির দুর্বল অবস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় রেকর্ড বাজেট ঘাটতিতে পড়েছে দেশটি। কারণ সৌদি আরবের রাজস্বের সিংহভাগ আসে জ্বালানি তেল রফতানি থেকে।
এছাড়া কাতার থেকে ২০১৪ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত বছর এসেছে ৩৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এছাড়া ওমান থেকে ২০১৪ সালে ৮৩ কোটি ও ২০১৫ সালে ৯২ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ১২১ কোটি ৪০ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০১৪ সালে ২৩৮ কোটি ৪০ লাখ ও ২০১৫ সালে ২৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর এনআরবি চেয়ারপারসন শেকিল চৌধুরী বলেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সমস্যা চলছে। ফলে প্রবাসীদের আয়ও কমে গেছে। ইরান-সৌদি উত্তেজনাও প্রবাসীদের আয়ে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। এছাড়া কিছু অভিযোগের ফলে আমাদের শ্রমিক পাঠানো আটকে আছে। তবে জঙ্গি সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ, তা আমরা অন্য দেশের চেয়ে কম মোকাবেলা করছি।
তথ্যমতে, ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৩৮৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৬৯ কোটি ৯০ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ১৪৫ কোটি ৮০ লাখ ও জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে ১৩০ কোটি ২০ লাখ ডলার।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, তেলের দাম কমে যাওয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার প্রভাব রেমিট্যান্সপ্রবাহে কিছুটা পড়বে। তবে বাংলাদেশীরা যে ধরনের কাজ করেন, সে ধরনের শ্রমিক এসব দেশ সহজে পাবে না। ফলে বাংলাদেশীদের ওপরই নির্ভর করতে হবে। এছাড়া এখন আগের চেয়ে অনেক দক্ষ শ্রমিক যাচ্ছেন। তার পরও ওমানের মতো কিছু দেশে শ্রমিক পাঠানোর দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
Discussion about this post