ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার ন্যূনতম হার মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে যেটি বেশি হয়, সে অনুপাতেই মূলধন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকগুলোকে। চলতি বছরের ৩০ জুন ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার হার ছিল ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয়ে পড়লে এ হার নেমে আসবে ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে। এতে ঝুঁকিতে পড়বে পুরো ব্যাংকিং খাত। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ও অভিঘাত শোষণক্ষমতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে কার্যরত ৫৬টি ব্যাংকের ওপর বিভিন্ন অভিঘাত প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের অভিঘাত শোষণক্ষমতা নিরূপণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে, মূলধন পর্যাপ্ততার হার কেমন, তাও উঠে এসেছে; ব্যাংকিং ভাষায় যাকে বলা হয় স্ট্রেস টেস্ট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ইঙ্গিত দেয়ার অর্থ হলো, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বড় গ্রহীতাদের দিকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে, যেন কোনোভাবেই তারা খেলাপি হয়ে না পড়ে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয়ে পড়লে ব্যাংকিং খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার হার ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে নেমে আসবে। সর্বাধিক স্থিতিসংবলিত খাতের ৩ শতাংশ নিয়মিত ঋণ খেলাপি হলে ১০ দশমিক ২ শতাংশে নেমে যাবে মূলধন পর্যাপ্ততার হার। আর খেলাপি ঋণের ৫ শতাংশ নিম্নমান থেকে সন্দেহজনক এবং সন্দেহজনক থেকে মন্দ বা ক্ষতিজনক হলে মূলধন পর্যাপ্ততার হার নেমে আসবে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে।
এছাড়া ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানতের মূল্য ১০ শতাংশ কমলে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশে নেমে আসবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ শতাংশ বাড়লে এ হার হবে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। পাশাপাশি সুদহার ১ শতাংশ হারে পরিবর্তিত হলে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ১০ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসবে। মুদ্রাবিনিময় হার যদি ৫ শতাংশ হারে পরিবর্তিত হয়, তবে এ হার হবে ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এছাড়া ইকুইটি মূল্য যদি ১০ শতাংশ হারে কমে, তবে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ১০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে নেমে আসবে। এ অভিঘাতগুলো পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের কোনো ঋণ বিরূপভাবে খেলাপি হলে ব্যাংকিং খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার হার সবচেয়ে বেশি কমে যাবে।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই শীর্ষ গ্রহীতাদের ব্যাপারে আরো মনোযোগী হতে হবে; যাতে খেলাপি হয়ে ব্যাংকের মূলধনের পাশাপাশি অন্য ব্যাংকেও এ অভিঘাত আঘাত করতে না পারে। এটা সময়োপযোগী ইঙ্গিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি গ্রাহক ছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৬০ জন। পরবর্তী নয় মাস অর্থাত্ ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত আরো ৩১ হাজার ৬২১ জন বেড়ে মোট খেলাপি গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮১ জনে। যদিও গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে ৪ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সুপারনিউমারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তার পূর্বাভাস দিয়ে সতর্ক করা এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য। ব্যাংকের যে মূলধন রয়েছে, তাতে যেন কোনো আঘাত না আসে। ব্যাংকের সম্পদ কী অবস্থায় আছে, এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে সেটাও তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। আর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। অর্থাত্ খেলাপি ঋণ বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।
হিসাবে দেখা গেছে, জুন শেষে অগ্রণীর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫০৬ কোটি, বেসিকের ৪ হাজার ৩০৭ কোটি, জনতার ৩ হাজার ৮২৫ কোটি, রূপালীর ১ হাজার ৫২২ কোটি ও সোনালী ব্যাংকের ৮ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। এ সময়ে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৪৭৮ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকের ১ হাজার ৬৬ কোটি, এক্সিমের ১ হাজার ১৩ কোটি, ন্যাশনালের ১ হাজার ৯৪ কোটি, প্রাইমের ১ হাজার ৫৫ কোটি, পূবালীর ৯৭৯ কোটি, দ্য সিটির ৯৫৮ কোটি ও ইউসিবিএলের ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা।
বিদেশী ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৯২০ কোটি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ৬২৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৩১০ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৯৭৭ কোটি টাকা।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন অগামী বছর থেকে ব্যাসেল-৩ বাস্তায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তার আগে চলতি জুনে ব্যাসেল-২ নীতিমালা মেনে মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি-বেসরকারি নয় ব্যাংক। তবে কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মূলধন সংরক্ষণ করায় ব্যাংকিং খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার হার ন্যূনতম সীমা ১০ শতাংশ পেরিয়েছে, দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। যদিও গত মার্চে এ হার ছিল ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ ব্যাংকগুলো হচ্ছে— সোনালী, জনতা, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক ও প্রিমিয়ার ব্যাংক।
ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে ন্যূনতম মাত্রা (১০ শতাংশ) থেকে অতিরিক্ত আরো দশমিক ৬২ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে।
Discussion about this post