অর্থনীতিতে সাধারণত সঞ্চয় ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মধ্যে দুটি বিপরীতমুখী প্রবণতা থাকে। একটির জনপ্রিয়তা বাড়লে কমে অন্যটিতে বিনিয়োগের ধারা। দেশে কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজারে মন্দা চললেও আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদহার ছিল আকর্ষণীয়। তবে চলতি বছর আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদহারও পড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে স্বল্প ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ। ফলে সমাজের সুদ ও মুনাফার ওপর নির্ভরশীল অংশটির কাছে বিনিয়োগ উপযোগী বিকল্প কিছু না থাকায় বেশ বিপাকেই পড়েছেন তারা।
২০১০ সালের ধসের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের শেয়ারবাজার। গত এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচকটি হারিয়েছে ৫৫৩ পয়েন্ট। এ সময়ে আমানতের সুদহারও গড়ে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও কমেছে গড়ে ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
সুদহার কমে যাওয়ায় ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১২’-এর অর্থে পরিচালিত শিক্ষাবৃত্তি প্রকল্প ঘিরেও শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার কোটি টাকার স্থায়ী আমানত থেকে প্রাপ্ত সুদ থেকেই উপবৃত্তি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সুদহার কমে যাওয়ায় সম্প্রতি এ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি তুলে ধরে নীতিসহায়তা চেয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকে উপস্থাপিত ব্যাংকগুলোর ঘোষিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের অক্টোবরে এক-দুই বছর মেয়াদি স্থায়ী আমানতে সোনালী ব্যাংকের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। চলতি বছরের অক্টোবরে তা কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭-৮ শতাংশে। পূবালী ব্যাংকের একই মেয়াদি আমানতের সুদহার ৯ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশে। সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ; গত আগস্ট পর্যন্ত যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশে।
পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকঋণের সুদহার কমলে আমানতের সুদহারও কমবে। ব্যাংকের কাছে এখন প্রচুর অলস অর্থ রয়েছে। এ অর্থ বিনিয়োগের জন্য তারা সুদহার কমিয়েছে। ব্যাংক যেহেতু ঋণের সুদহার কমিয়েছে, তাই আমানতের ওপর সুদহার এমনিতেই কমবে। ফলে সঞ্চয়পত্রনির্ভরশীলদের তাতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।
এদিকে গত মে মাসে পাঁচ ধরনের সরকারি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানো হয়েছে। প্রতিটি সঞ্চয়পত্রে গড়ে মুনাফার হার কমেছে ১০-১৫ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রগুলো হচ্ছে— পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র, তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও তিন বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র।
জানা গেছে, পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। নতুন মুনাফার হার নির্ধারিত হয়েছে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর ওপর প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম। ফলে সামগ্রিক মুনাফা কমেছে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশীয় পয়েন্ট। এ সঞ্চয়পত্রে শুধু নারীদের বিনিয়োগের সুযোগ ছিল।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও আধাসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চালু করা পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। নতুন মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম বাবদ দশমিক ৯৯ শতাংশও তুলে নেয়া হয়েছে। ফলে এ সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমেছে ২ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট। তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর ব্যাংকে মুনাফার হার ছিল ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। নতুন নির্ধারিত হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, মুনাফা কমেছে ১ দশমিক ৯৬ শতাংশীয় পয়েন্ট। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। মুনাফা ১ দশমিক ৯১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানোর পাশাপাশি প্রত্যাহার করা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম বাবদ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তাতে এ সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমেছে ২ দশমিক ৯ শতাংশীয় পয়েন্ট। তিন বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। নতুন মুনাফার হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। দশমিক ৭৯ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম তুলে নেয়ায় মুনাফা কমেছে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশীয় পয়েন্ট।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক রেটের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয়। ব্যাংক রেট কমলেও যদি সঞ্চয়পত্রের সুদহার না কমে, তাহলে সবাই সঞ্চয়পত্র কেনার দিকেই ঝুঁকবে। তাতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। আর সরকারও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে।
এদিকে সুদহার কমায় ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১২’-এর অর্থে পরিচালিত শিক্ষাবৃত্তি প্রকল্পের ভবিষ্যৎও পড়েছে হুমকিতে। এ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জানান, ট্রাস্টের উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান প্রধানমন্ত্রী। এ ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ হাজার কোটি টাকা সিডমানি হিসেবে দেন। সে অর্থ পাঁচটি সরকারি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে। এ থেকে প্রাপ্ত সুদ দিয়েই ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৯ শিক্ষার্থীকে ৯১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা উপবৃত্তি দেয়া হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আমানত থেকে সুদ পাওয়া গেছে সাড়ে ১২ শতাংশ। চলতি বছরের ৭ জুলাই সোনালী ব্যাংক সুদহার কমিয়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এর পর ৩০ সেপ্টেম্বর সুদহার আরো কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে শেয়ারবাজার মন্দায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তথা নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের অনেকেই ব্যাংকঋণ কিংবা স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন। শেয়ারদরের টানা পতনে তাদের অনেকেই পুঁজির বেশির ভাগ অংশ হারিয়েছেন। এর মধ্যে মার্জিন ঋণ নিয়ে যেসব বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের অবস্থা আরো খারাপ। নতুন করে পুঁজি সংগ্রহ করতে না পারায় শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়েছে। গত এক বছরে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকটি ৫৫৩ পয়েন্ট হারিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক সচিব বলেন, সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর হলো বিনিয়োগকারীদের সর্বশেষ স্থল। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশ যখন সুবিধাজনক না থাকে, তখন স্থায়ী আমানত ও সঞ্চয়পত্রে ঝোঁকে মানুষ। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য এখন বড় ধরনের পুঁজিনির্ভর। তাই ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের শেষ আশ্রয়স্থল সঞ্চয়পত্র। তবে সঞ্চয়পত্রের সুদহারও যেহেতু কমেছে, সে কারণে বিনিয়োগের উপযুক্ত বিকল্প আর তাদের হাতে থাকছে না। ফলে ওই শ্রেণীভুক্ত মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
Discussion about this post