ব্যাংকে ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয় দেড় বছর আগে। সুদহার কমানোর কথা বলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে বেশ কিছু সুবিধাও নিয়েছে। তবে সুদহার এখনো একক অঙ্কে নেমে আসেনি। এ অবস্থায় সুদহার কমাতে নতুন করে আবারও কমিটি গঠন করেছে সরকার। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব
প্রথম আলো: ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা দেড় বছর আগে সুদহার কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখনো কেন কমল না?
আনিস এ খান: সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে যে তহবিল আছে, তা বিভিন্ন ব্যাংকে উচ্চ সুদে জমা আছে। এখন এসব আমানত নবায়নের জন্য চিঠি আসছে। সরকারি সংস্থাগুলো ব্যাংকগুলোর সুদহার জানতে চাইছে। কম পেলে তারা টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে। ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) ঠিক রাখতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ বাড়িয়ে ওই টাকা রেখে দিচ্ছে। আবার রাজস্ব সংগ্রহ কমে যাওয়ায় সরকারও ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ আরও কমে যেতে পারে। এতে ঋণের সুদহার কমিয়ে আনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, বাজারের তহবিলের জোগান ও চাহিদা সুদহার নির্ধারণ করে দেয়।
প্রথম আলো: সুদহার কমানোর আশ্বাস দিয়ে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সুবিধা নিল। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও বিভিন্ন নীতি পরিবর্তন করল। এর সুবিধা তো শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ পেল না?
আনিস এ খান: এসব সুবিধা না পেলে সুদহার আরও অনেক বেশি থাকত। ব্যাংকগুলো সুদহার ১৪ থেকে ১২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। কেউ কেউ ৯ শতাংশও করেছে। সুদহার আরও কমাতে হলে এ জন্য সময় দিতে হবে। হঠাৎ করে সুদহার কমিয়ে দিলে ব্যাংকগুলো লোকসানে চলে যাবে। এতে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারের রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রথম আলো: সুদহার কমাতে সরকার যে কমিটি করেছে, তাতে কি সুদহার কমবে। নাকি সুদহার নির্ধারণ বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে?
আনিস এ খান: কমিটি নিশ্চয়ই ভালো সুরাহা বের করবে। তবে বাজারের চাহিদা ও জোগানই সুদহার নির্ধারণে বড় নিয়ামক। সারা বিশ্বেই সুদহার নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। বাংলাদেশও নিশ্চয় এর বাইরে যেতে পারবে না। আর খেলাপি ঋণ বাড়লে সুদহার বেড়ে যায়। তাই খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খেলাপি কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বেশি সুদহারের কারণে ঋণখেলাপি হচ্ছে কি না, তা বিশ্লেষণ করে বলতে হবে। ব্যবসায়ীদের কাছে তহবিল পাওয়াটা বড় বিষয়।
প্রথম আলো: ৩৭ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শেষ করলেন। এখন বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত কি সঠিকভাবে চলছে?
আনিস এ খান: বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা অধিগ্রহণের পথে যেতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের ব্যাংকের ক্ষেত্রেই এ উদ্যোগ প্রয়োজন। এর কোনো বিকল্প নেই। অন্য দেশের মতো ভারতও একই পথে গেছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে করপোরেট গভর্ন্যান্স বা প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
প্রথম আলো: ব্যাংকগুলোর ঋণ খারাপ হয়ে পড়ছে কেন?
আনিস এ খান: ব্যাংকের ব্যবসা ৮০ শতাংশই ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। এ ব্যবসা ধরতে গিয়ে ব্যাংকগুলো অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এর ফলে অনেক সময় ব্যাংকগুলো আপস (কম্প্রোমাইজ) করছে। আবার মুনাফার একটা লক্ষ্য থাকে। এ কারণেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ব্যাংকের কাজ গ্রাহক থেকে আমানত নিয়ে আবার বিনিয়োগ করা। তাই ঋণ দেওয়ার আগে ব্যাংকারদের সব সময় চিন্তা করতে হবে, কাকে টাকা দিচ্ছি। ব্যবসায়ী সৎ কিনা। টাকার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা। এসবে নজরদারি বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো: ব্যাংক খাতের সুশাসন পরিস্থিতি কেমন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে বলে মনে করেন আপনি?
আনিস এ খান: সুশাসনে ঘাটতি থাকায় ব্যাংক খাতে সমস্যা হচ্ছে। সুশাসনের উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে আসতে হবে। সরকারের মধ্যে অনেক অভিজ্ঞ ও উচ্চশিক্ষিত মানুষ আছে। ব্যাংক খাতে উদ্যোক্তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের কাছে অনুরোধ করব, যাতে ব্যাংক খাতে বেস্ট করপোরেট গভর্ন্যান্স প্রয়োগের ব্যবস্থা করেন। তাঁরা চাইলেই অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঠিক হয়ে যাবে। দেশের ব্যাংক খাতও ঠিক হয়ে যাবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে। জাপান ও যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যেমন দেওয়া হয়েছে, তার ৯০ শতাংশ হলেও দিতে হবে।
আমি মনে করি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবার পরামর্শ শুনবে, তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বাধীনভাবে। বর্তমানে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক দুজন ডেপুটি গভর্নর দিয়ে চলে না। দীর্ঘদিন দুটি পদ খালি। শূন্য পদ দুটি পূরণে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
Discussion about this post