আমজাদ হোসেন দীর্ঘ চার দশক ধরে চিংড়ি রপ্তানি করে আসছেন। এ ছাড়া তাঁর হোটেল, পাট, আবাসনসহ অন্যান্য আরও বেশ কিছু খাতে ব্যবসা রয়েছে। নিজের ও পরিবারের নামের পাশাপাশি বেনামেও অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তিনি। তিনি বিদেশেও একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। এসব অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এস এম আমজাদ হোসেন পণ্য রপ্তানি করেছেন এক দেশে, টাকা আসছে অন্য দেশ থেকে, যা বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে অপরাধ।
যেভাবে অর্থ আত্মসাৎ
এস এম আমজাদ হোসেন খুলনা বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক। প্রতিষ্ঠানটির বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার তাঁর স্ত্রী সুফিয়া খাতুনের নামে। ২০১৬ সালের ১ জুন এসবিএসি ব্যাংকের খুলনা শাখায় প্রতিষ্ঠানটির নামে ঋণ আবেদন করা হয়। পরদিনই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হয়। পরে ঋণসীমা বাড়িয়ে ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা করা হয়।
নথিপত্রে খুলনা বিল্ডার্সের ব্যবসার ধরন হিসেবে নির্মাণ ও আমদানি-রপ্তানির কথা বলা হয়েছে। তবে খুলনার যে ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেখানে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। আর ব্যাংকের নথিতে খুলনা বিল্ডার্সের ঢাকার গোডাউনে ৫০ কোটি টাকার মালামাল রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকটির খুলনা শাখার কর্মকর্তারা বিএফআইইউর পরিদর্শক দলকে জানিয়েছেন, শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশে গোডাউনে রাখা মালামাল সম্পর্কে ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদন বলছে, এটি নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে আমানতকারীদের ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন আমজাদ হোসেন।
এদিকে এসবিএসি ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে ২০১৮ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি ৯ ব্যক্তির নামে ২২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ৫ কোটি টাকা আমানত দেখানো হয়। অর্থাৎ স্থায়ী আমানতের ৪৫০ শতাংশের বেশি টাকা তুলে নেওয়া হয়। এই ৫ কোটি টাকা আমানতের জোগান দেওয়া হয় সাউদার্ন ফুড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে, যেটির চেয়ারম্যান হলেন আমজাদের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন, আর ভাই এস এম আবুল হোসেন প্রতিনিধি হিসেবে আছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মচারীদের ব্যবহার করে নানাভাবে লেনদেন করে সুবিধা নেন এস এম আমজাদ হোসেন।
এসব নিয়ে জানতে চাইলে এস এম আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনা বিল্ডার্স দুটি ভবন নির্মাণ করেছে, যার ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ হয়ে যাচ্ছে। আমার শেয়ারের বিপরীতে এ ঋণ নেওয়া হয়েছে। আর যাঁদের ঋণ নেওয়ার কথা বলছেন, তাঁরা আমার প্রতিষ্ঠানে ৩৫ থেকে ৪০ বছর ধরে চাকরি করছেন। তাঁরা কেন ঋণ নিলেন, আমি জানি না।’ এসব ঋণ পরিশোধ হয়ে গেছে বলে তিনি দাবি করেন।
প্রণোদনার টাকাও আত্মসাৎ
এস এম আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন মুনস্টার জুট মিলের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মাসে বেতন-ভাতা বাবদ গড়ে ব্যয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। অথচ প্রতিষ্ঠানটি সরকারি প্রণোদনা তহবিল থেকে বেতন বাবদ ১ কোটি ২ লাখ টাকা নিয়েছে। এ ঋণের সুদহার ছিল ২ শতাংশ। বিএফআইইউ বলছে, আমজাদ হোসেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে প্রণোদনার অর্থ তুলেছেন।
এদিকে আমজাদ হোসেনের ছয় প্রতিষ্ঠান ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত রপ্তানির বিপরীতে ৪২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা নগদ সহায়তা নিয়েছে। বিএফআইইউ বলছে, তিনি পণ্যের রপ্তানি মূল্য বেশি দেখিয়ে প্রণোদনা নিয়েছেন। এ জন্য অডিট অধিদপ্তর ২৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ফেরত দিতে বলেছে।
এস এম আমজাদ হোসেন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেতন কম হলেও মজুরি অনেক। সব মিলিয়ে যে খরচ হয়, তা-ই তোলা হয়েছে। এর বেশি নয়। আর নগদ সহায়তা ফেরত দেওয়ার কোনো নির্দেশনা পাইনি।’
বিদেশে যত প্রতিষ্ঠান
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাউদার্ন ফুডস ইনক ও কলকাতার রূপসা ফিশ লিমিটেডের কাছে নিয়মিত চিংড়ি রপ্তানি করছে আমজাদ হোসেনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তিনিই আবার যুক্তরাষ্ট্র ও কলকাতার এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক। বিএফআইইউ বলছে, আমজাদ হোসেন ভিন্ন ভিন্ন দেশে কোম্পানি খুলে সেগুলোর সঙ্গেই মূলত আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তিনি অর্থ পাচারে জড়িত থাকতে পারেন। কারণ, বিদেশে ওই সব কোম্পানি খোলা হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে কোনো টাকা নেননি তিনি। আবার রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় পণ্য রপ্তানি না করলেও এসব দেশ থেকে টাকা এসেছে আমজাদ হোসেনের ব্যাংক হিসাবে।
এ প্রসঙ্গে এস এম আমজাদ হোসেন এ নিয়ে বলেন, ‘টাকা কোথা থেকে এল, এটা কোনো বিষয় নয়। বিলের বিপরীতে টাকা এলেই হলো। আমি ৪০ বছর ধরে চিংড়ি রপ্তানি করে আসছি।’
বেনামে যত প্রতিষ্ঠান
সাউদার্ন ফুডস, বাগেরহাট সি ফুড এবং রূপসা ফিশ অ্যান্ড অ্যালাইড—এই তিন প্রতিষ্ঠানই আমজাদ হোসেনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। আলফা অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো এক্সপোর্টের মালিকানা আমজাদ হোসেনের ভাইয়ের মেয়ে ও কর্মচারীদের নামে দেখানো হলেও প্রকৃত সুবিধাভোগী তিনিই। আলফা অ্যাকসেসরিজের ঋণ এখন ১৬৮ কোটি টাকা। এসব ঋণ হয়েছে ঋণপত্রের (এলসি) মূল্য সময়মতো পরিশোধ না করায়। বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমজাদ হোসেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে ক্ষমতা অপব্যবহার করে ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়েছেন।
এদিকে এসবিএসি ব্যাংকে এস এম আমজাদ হোসেনের ২২ কোটি টাকা, তাঁর স্ত্রী সুফিয়া বেগমের ২৩ কোটি টাকা ও মেয়ে মিস তাজরীর ৩ কোটি ৫৬৫ লাখ টাকা, রূপসা ফিশের ১ কোটি টাকা, সাউদার্ন ফুডের ৩৪ কোটি টাকা, মুনস্টার পলিমারের ২৭ কোটি টাকা ও মুনস্টার সিরামিকের ৩৪ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। এভাবে সব মিলিয়ে ব্যাংকটিতে আমজাদ নামে-বেনামে ১১৭ কোটি টাকা জোগান দিয়েছেন। অর্থাৎ ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের ১৭ শতাংশই তাঁর নিয়ন্ত্রণে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে, কোনো ব্যাংকে কোনো ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের শেয়ার কোনোভাবেই ১০ শতাংশের বেশি হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন এই ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। যে সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। এই কারণে এসব ব্যাংকের চেয়ারম্যান এত সাহস পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে, ঘটনার সত্যতা পেলে দ্রুত চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া। কারণ, এমন ব্যক্তিরা আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর। আমার সময়ে অনেক চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন এমন সিদ্ধান্ত শোনা যায় না। অথচ এই ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আছে।
Discussion about this post