কার্ড সেবা ও ট্রাভেলার চেকের জন্য বিশ্বখ্যাত আমেরিকান এক্সপ্রেস বা অ্যামেক্স। সেই অ্যামেক্সকে সঙ্গে নিয়ে সিটি ব্যাংক এখন দেশের শীর্ষ ব্যাংকগুলোর একটি। আর কার্ড সেবায় সবার ওপরে। দেশে অ্যামেক্সের কার্ড সেবার ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কথা বলেছেন সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার। বলেছেন অ্যামেক্সকে সঙ্গে নিয়ে সিটি ব্যাংকের বড় হওয়ার গল্প।
দেশে অ্যামেক্সের ১০ বছর
১৮৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যাত্রা শুরু করে আমেরিকান এক্সপ্রেস বা অ্যামেক্স। আমেরিকার বাজারের ২০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে অ্যামেক্স। ফরচুন ৫০০ শীর্ষ কোম্পানিতে অ্যামেক্সের অবস্থান ৮৬।
বাংলাদেশে অ্যামেক্সের সেবা চালু নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হয়, সিটি ব্যাংকের তখনকার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এটা নিতে চায়নি। কারণ, বড় অঙ্কের খরচের বিষয় ছিল। আজিজ আল কায়সার বলেন, ‘ওই সময়ে রিটেইল বিভাগের প্রধান ছিলেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন। তাঁকেই আমি বললাম, অ্যামেক্সকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি। তুমি কি এটা বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারবা? মাসরুর আরেফিন আমাকে জানায়, “এটা আমার স্বপ্ন। আমি এটা করবই।”
সব প্রক্রিয়া শেষ করে ২০০৯ সালের ৯ নভেম্বর সিটি ব্যাংক অ্যামেক্সের ক্রেডিট কার্ড সেবা চালু করে। অ্যামেক্স এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কার্ড।
আজিজ আল কায়সার বলেন, ‘অ্যামেক্স নিজেও অভিভূত বাংলাদেশে তাদের সেবার বিস্তৃতি দেখে। অ্যামেক্সের কারণে দেশের কার্ড সেবার ৩০ শতাংশই এখন সিটি ব্যাংকের।’
জানতে চেয়েছিলাম, অ্যামেক্স নিয়ে আপনারা কি খুশি?
তাঁর সহজ জবাব, ‘আমরা খুশি। কারণ, বাংলাদেশে অ্যামেক্সের কার্ড সেবাকে আমরা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। যেটা এ অঞ্চলের অনেক দেশ পারেনি।’
যোগ করেন, ‘আগামী দুই থেকে তিন বছরে অ্যামেক্সের কার্ডসংখ্যা বেড়ে ২০-২৫ লাখ হলে আমি আরও খুশি হব। এটা সম্ভব। মোবাইল কোম্পানিগুলো যত সিম বিক্রি করেছে, তার ১ শতাংশ মানুষও কার্ড ব্যবহার করে না। আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে।’
সময়ে সময়ে কার্ডে নানা সুবিধা যোগ করেছে সিটি ব্যাংক। পয়েন্ট অর্জন, বিল পরিশোধ, টাকা উত্তোলনসহ আরও নানা সুবিধা। বাংলাদেশে সিটি ব্যাংকই এসব প্রথা চালু করে। পরে অন্য ব্যাংকগুলো যা অনুসরণ করে।
আজিজ আল কায়সার বললেন, ‘অ্যামেক্সের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সিটি ব্যাংকের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বহির্বিশ্বেও। সত্যিই অ্যামেক্স সিটি ব্যাংকের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। আর কার্ড সেবা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় নীতি–সহায়তা দিয়েছে। তবে এখন সময় কার্ডের ঋণের সীমা বাড়ানোর। একজন গ্রাহককে যদি এক কোটি টাকা ঋণ দেওয়া যায়, তাহলে কার্ডে কেন সেই পরিমাণ ঋণ দেওয়া যাবে না।’
পরিকল্পনা
নগদ টাকা বহন করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আর সারা বিশ্বেই নগদ টাকার ব্যবহার কমে আসছে। বাংলাদেশও সেই পথে। তাই প্লাস্টিকের কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনই ভবিষ্যৎ। যাঁরা আয় করেন, তাঁদের সবাই একসময় কার্ড ব্যবহার করবেন—এমন স্বপ্নই দেখেন তিনি। এ কারণে ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করে সারা দেশে সেবা ছড়িয়ে দিতে চায় সিটি ব্যাংক।
জানতে চেয়েছিলাম, নতুন কী কৌশলে সেবা দেবেন। আজিজ আল কায়সার জানালেন, ‘নতুন যুগে মোবাইলের মাধ্যমে কিউআর কোড দিয়ে লেনদেন করা যাচ্ছে। আমরাও একইভাবে সারা দেশে যেতে চাই। মোবাইলের মাধ্যমে সেবা পাওয়ায় হিসাবের যাবতীয় তাৎক্ষণিক জানা যায়।’
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে খুব বেশি যেতে পারেনি অ্যামেক্স। চেয়ারম্যানের জবাব, ‘গত ১০ বছরে আমরা খুব ভালো করে জেনেছি, কীভাবে কার্ড ব্যবসা করতে হয়। এখন বিভিন্ন মফস্বল শহরে কার্ড সেবা দেওয়া হচ্ছে।’ আরও বলেন, এখন উবার, ট্যাক্সি, ছোট দোকানে কার্ড সেবা চালু করতে হবে। আমরা সেদিকই যাচ্ছি। ভারতে ছোট দোকানেও কার্ড ব্যবহার করা যায়।’
আজিজ আল কায়সার বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, রিটেইল বা খুচরা ব্যাংকিংয়ে আরও ভালো করবে সিটি ব্যাংক। রিটেইলে হাইপার মার্কেট করতে চেয়েছিলাম, পারিনি। এখন আবারও সেই পথে আছি। কারণ, ১৬ কোটি মানুষের দেশে অল্প কয়েকটি করপোরেটকে সেবা দিলে তো হবে না। সবাইকে ব্যাংকসেবায় আনতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তা অর্জন করব। যা সবার চোখে পড়বে।’
আজিজ আল কায়সার বলেন, ‘আমি কোনো আপস (কম্প্রোমাইজ) করি না। আগামী ১০ বছরে সিটি দেশের সেরা ব্যাংক হয়ে উঠবে, এটাই আমার চাওয়া। শুধু সেরা নয়, সুনাম ও নিয়মকানুন পরিপালনেও। আমি চাই, সিটি ব্যাংক যেন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে। দেশের পাশাপাশি সারা বিশ্বেও সিটি ব্যাংকের ভালো ভাবমূর্তি ছড়িয়ে পড়ে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কাজ করছি। সরকারের যে ইচ্ছা, ডিজিটাল বাংলাদেশের। আমরা এ জন্যও কাজ করছি।’
সিটি ব্যাংকের তখন–এখন
একসময় সিটি ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক ছিল। সে থেকে ১৫ বছর আগে বের হয়ে আসে। এরপর প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং শুরু করে। এখন আধুনিক ধারার ব্যাংকিং করছে। সিটি ব্যাংকের ভাবমূর্তি ভালো হয়েছে। এখন দেশের পাশাপাশি মালয়েশিয়া সেবা দিচ্ছে, হংকংয়ে কার্যালয় খোলা হয়েছে। আরও দেশে সেবা ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক হতে চায় সিটি। সিটি ব্যাংকের পর্ষদে যুক্ত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)।
আজিজ আল কায়সার বলেন, ‘আমরা ব্যাংক পরিচালনায় কোনো হস্তক্ষেপ করি না। বৈশ্বিক যে চর্চা আছে, আমরা তা অনুসরণ করতে চাই। ব্যবস্থাপনা পর্ষদ যেন পেশাদারত্বের সঙ্গে ব্যাংক চালায়, আমরা সেটাই চাই। এ জন্যই আইএফসিকে আনা হয়েছে।’
সিটি ব্যাংক এ পর্যায়ে আসতে বর্তমান ও সাবেক পরিচালক, কর্মকর্তা—সবাই সহযোগিতা করেছেন বলে জানান চেয়ারম্যান। বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা, সিটি ব্যাংক শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, বৈশ্বিকভাবে ভালো ব্যাংকের তালিকায় যাক।’
চেয়ারম্যান জানান, ‘লোগো পরিবর্তন হলে সবার মধ্যে স্পৃহা বেড়ে যাবে। এ জন্য হঠাৎ করে পর্ষদে লোগো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এক দিনের মধ্যে সারা দেশে সিটি ব্যাংকের লোগো পরিবর্তন হয়ে গেল। সেটা ২০০৮ সালের ৫ জুলাই। কিছুদিন পর অ্যামেক্সের লোগো এল। রাতারাতি ব্যাংকটির ভাবমূর্তি বেড়ে গেল।’
সিটি ব্যাংকই প্রথম এয়ারপোর্টে লাউঞ্জ চালু করে। ওই সময় বিমানবন্দরে কোনো লাউঞ্জ ছিল না। এখন আরও অনেকে এ সেবা চালু করেছে। সিটি ব্যাংক প্রথম প্রাইওরিটি ব্যাংকিং চালু করে। এর ফলে সিটি ব্যাংকের ব্র্যান্ড ভ্যালু বেড়ে যায়।
আজিজ আল কায়সার বলেন, ‘বেশির ভাগ ব্যাংকই প্রাইওরিটি সেবায় লোকসানে। আমরা মুনাফা করেছি। কারণ, দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা হচ্ছে।’
ব্যাংক খাত নিয়ে
আজিজ আল কায়সার বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে আর্থিক খাতে টানাপোড়েন চলছে। আমরা দেখছি, আমানতের সুদহার বাড়ছে। বেসরকারি ব্যাংকে টাকা থাকছে না। বেসরকারি ঋণও কমছে। তার মানে এটা নয় যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। অবশ্যই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো একটু গতি হারিয়েছে।’
আরও বলেন, ব্যাংকগুলো টালমাটাল অবস্থায় আছে। নিশ্চয়ই এটা নতুন করে সাজানোর প্রয়োজন আছে। আর্থিক খাত কতটা সংস্কার হয়েছে জানি না, তবে সিটি ব্যাংক অনেক সংস্কার করেছে। ঋণের পোর্টফোলিও নতুন করে সাজিয়েছে। সামনের দিনে সিটি ব্যাংক আরও ভালো করবে। নতুন নতুন সেবাপণ্য চালু করবে। সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করবে।’
আজিজ আল কায়সার মনে করেন, ‘সুদহার যে পর্যায়ে আছে, তাতে ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলোকে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে। ব্যাংকে চাহিদার তুলনায় বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। আমানতেও সুদহার বেশি। দক্ষতা বাড়িয়ে ঋণের সুদ কমাতে হবে।’
তিনি মনে করেন, ‘ব্যাংকসেবা দিতে শাখার প্রয়োজন নেই। কিয়স্ক বা ডিজিটাল মাধ্যমে সেবা দেওয়া সম্ভব। সময় এসেছে এমন আধুনিক চিন্তা করার। তাতে সুদহার কমে আসবে।’
একনজরে সিটি ব্যাংক
• প্রতিষ্ঠা–১৯৮৩ সালে
• আমানত–২৫,০৩৬ কোটি টাকা (৩০ নভেম্বর পর্যন্ত)
• ঋণ–২৫,৯৮৮ কোটি টাকা (৩০ নভেম্বর পর্যন্ত)
• শাখা–১৩০
• কর্মকর্তা–৩৮৫৮ জন
• এটিএম–৩৬৯
• কার্ড–১০ লাখ ৬৮ হাজার
• গ্রাহক–১৭ লাখ
• ২০১৮ সালে নিট মুনাফা–২০১ কোটি
• শেয়ারবাজারে তালিকভুক্ত হয় ১৯৮৬ সালে।
• রোববার শেয়ারের দাম ছিল ২২ টাকা ৩০ পয়সা
একনজরে অ্যামেক্স কার্ড
• চালু ২০০৯ সালে ৯ নভেম্বর
• ২০১৪ সালেই দেশের কার্ড সেবায় শীর্ষস্থানে
• দেশের সবচেয়ে বেশি কার্ড ব্যবহার
• ১০ বছরে ২০ কোটি লেনদেন
• ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লেনদেন
• পয়েন্ট অব সেলস ২৬ হাজার ৫০০
• প্রথম রিওয়ার্ড পদ্ধতি চালু
• প্রথম লাউঞ্জ চালু
• কো ব্র্যান্ডেড কার্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আগোরার সঙ্গে
• বিমানের সঙ্গে কো ব্র্যান্ডেড কার্ড আসছে
Discussion about this post