শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এসএমই ফাউন্ডেশন। উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচন। এ লক্ষ্য সামনে রেখে শুরুতে এসএমই খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচিও হাতে নেয় সংস্থাটি। কিন্তু নয় বছরের মাথায় এসে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম। সংশ্লিষ্টরা এজন্য দায়ী করছেন বর্তমান চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারিতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) উদাসীনতাকে।
২০১৪ সালের ২১ মে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন সাবেক উপসচিব কেএম হাবিব উল্লাহ। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন তিনি। নিজের মেয়েকে নিয়োগ দেন প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা পদে। আর ব্যক্তিগত সহকারীকে দেন প্রশাসন, লজিস্টিক ও তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। চেয়ারম্যানের এ সিদ্ধান্তে সায় দেন ফাউন্ডেশনের তত্কালীন এমডি। বর্তমান এমডিও এ নিয়ে উদাসীন। এসব সিদ্ধান্তের বিষয়ে অনেকটা অন্ধকারে থাকতেন ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও।
চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেন ফাউন্ডেশনের এমডি। এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সংস্থাটির অধিকাংশ পর্ষদ সদস্য। ১১ জানুয়ারি ফাউন্ডেশনের পর্ষদ সভায় এ অবস্থান তুলে ধরেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে থমকে গেছে এসএমই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পর্ষদের একাধিক সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, চেয়ারম্যান পুরোপুরি নিজের প্রয়োজনে ফাউন্ডেশনটি ব্যবহার করছেন। অনেকটা এমডির ভূমিকাই পালন করছেন তিনি। ফলে পর্ষদের সব সদস্যই পদে থাকা নিয়ে এক রকম বিপত্তিতে রয়েছেন।
বণিক বার্তার নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট চাকরি বিধিমালার ১.১৬.৪ ও ১.১১.৬ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমান ও উপমহাব্যবস্থাপক এসএম নূরুল আলমকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন তত্কালীন এমডি সৈয়দ মো. ইহসানুল করিম। পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে অব্যাহতিপত্রে উল্লেখ করা হলেও ২০ আগস্টের পর্ষদ সভার নথিপত্র ও সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওইদিন এ-সংক্রান্ত কোনো আলোচনা ও সিদ্ধান্ত পর্ষদে হয়নি।
এ নিয়ে ক্ষুব্ধ পর্ষদ সদস্যরা ৬ সেপ্টেম্বর ফাউন্ডেশনের ৮৭তম পর্ষদ সভায় মতামত দেন, ‘কেবল চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় এমডি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। চেয়ারম্যানের নির্দেশে রাত ১২টায় দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতি প্রদান করে দেশের বিদ্যমান আইন ও ফাউন্ডেশনের চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে।’ এ সভায় বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— এস কে সুর চৌধুরী, মো. আবদুল মতিন, সেলিমা আহমাদ ও মির্জা নূরুল গনি শোভন।
এ কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো রকম সতর্কীকরণ ছাড়াই রাত ১২টায় তড়িঘড়ি করে দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতিপত্র দেয়া হয়েছে। এটি কোনো আইনে সমর্থন করে না। অব্যাহতির কোনো কারণ বলতে পারেননি এসএমই ফাউন্ডেশনের তত্কালীন এমডি সৈয়দ মো. ইহসানুল করিম। কমিটিকে তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। অব্যাহতিপত্রে ধারা ১.১৬.১০ কেটে দিয়ে তিনি স্বাক্ষর করলেও সেটি হয়েছে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুম বিল্লাহর চাপে।
পরে কমিটি মাসুম বিল্লাহর সাক্ষ্য নিয়ে নিশ্চিত হয় যে, ‘ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে কোনো নিয়ম-কানুন না মেনে গভীর রাতে এ অব্যাহতিপত্র তৈরি করেছেন চেয়ারম্যান। এ প্রক্রিয়ায় এমডি ও চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী ছাড়া অন্য কাউকে যুক্ত করা হয়নি।
তদন্তের পর কমিটি সিদ্ধান্ত দেয়, ‘দুই কর্মকর্তার অব্যাহতি প্রদানের কারণগুলো সরাসরি অব্যাহতি প্রদানের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং ফাউন্ডেশনের চাকরি বিধিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’ তাই অব্যাহতিপত্র প্রত্যাহার করে ওই দুজনকে স্বপদে পুনর্বহালের জন্য পর্ষদের কাছে সুপারিশ করে কমিটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসএমই ফাউন্ডেশনের সাবেক এমডি সৈয়দ মো. ইহসানুল করিম বলেন, ‘আমি কমিটির কাছে এমন কিছু বলিনি। তবে এসব তো ইজি বিষয়, ছোটখাটো বিষয়। এসব নিয়ে কথা বলতে আমি আগ্রহী নই। পাস্ট ইজ পাস্ট। তদন্ত হচ্ছে, কী সিদ্ধান্ত হয় দেখা যাক।’
এদিকে ১০ জানুয়ারি পর্ষদ সভা আহ্বান করে এসএমই ফাউন্ডেশন। তবে সভার আলোচ্যসূচিতে দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতির প্রতিবেদনের বিষয়টি না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পরিচালকরা। পরে সভা একদিন পিছিয়ে ১১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন এ বিষয়ে আলোচনা উঠলে উপস্থিত সদস্যদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন চেয়ারম্যান। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা শেষ হয়।
এ বিষয়ে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কেএম হাবিব উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ব্যক্তিগত সহকারী মাসুম বিল্লাহ জানান, ‘স্যার ভারতে আছেন। ১০-১২ দিন পর ফিরবেন।’ ফলে তার মতামত জানা সম্ভব হয়নি।
তবে পর্ষদের সদস্য ও নাসিব চেয়ারম্যান মির্জা নূরুল গনি শোভন বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেদনে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে সুপারিশ করা হয়েছে। আমি শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত আছি। আমরা জানিয়ে দিয়েছি, আমরা পর্ষদ সদস্যরা যথাযথ ভূমিকা রাখতে না পারলে অন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা সবাই এসএমই খাত উন্নয়নে কাজ করতে চাই।’
পর্ষদের আরেক সদস্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সুষেণ চন্দ্র দাস বলেন, ‘চেয়ারম্যান জোর করে দুজনকে অব্যাহতি দিয়েছেন। আমরা সবাই এর বিরোধিতা করছি, এর পরও উনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছেন না। কমিটিও তাদের বহাল করার সুপারিশ করেছে, তাতেও চেয়ারম্যান রাজি হচ্ছেন না। ফলে কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। সামনের সভায় এ বিষয়ে আবারো আলোচনা হবে।’ তবে পর্ষদের অন্য সদস্য অধ্যাপক ড. মমতাজউদ্দিন আহমেদ, লুনা সামসুদ্দোহা, সেলিমা আহমাদ এসব ঘটনার কথা অস্বীকার না করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে চেয়ারম্যানের মেয়েকে এসএমই ফাউন্ডেশনের পরামর্শক করার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৩০ জুন চেয়ারম্যান কেএম হাবিব উল্লাহর মেয়ে ড. নাযিয়া মিনজ হাবিব ফাউন্ডেশনের জিএম শাহীন আনোয়ারের কাছে নিজের একটি বায়োডাটা পাঠান। একই বছরের ২০ জুলাই চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুম বিল্লাহ ফাউন্ডেশনের জন্য পরামর্শক নিয়োগের লক্ষ্যে একটি স্মারক উপস্থাপন করেন। পর্ষদ সভায় কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই ২১ জুলাই চেয়ারম্যানের মেয়েকে ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক পরামর্শক হিসেবে নিয়োগপত্র দেন ফাউন্ডেশনের তত্কালীন এমডি সৈয়দ ইহসানুল করিম।
এ বিষয়ে এসএমই ফাউন্ডেশনের বর্তমান এমডি মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চেয়ারম্যানের মেয়ের চাকরির বিষয়ে তিনিই ভালো জবাব দিতে পারবেন। এ নিয়োগের সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতির বিষয়ে পর্ষদে আলোচনা চলছে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
এসএমই ফাউন্ডেশনে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা অপ্রত্যাশিত বলে মন্তব্য করেন ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব-উল-ইসলাম। তিনি বলেন, অধোগতির দিকে চলে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ীবান্ধব হওয়া উচিত। বেসরকারি খাত দিয়েই পরিচালনা করা উচিত এটি। বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা অপ্রত্যাশিত।
Discussion about this post