পণ্যের হালাল সনদের দিকে ঝুঁকছে দেশের করপোরেটরা। এরই মধ্যে ১৫টি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে সনদটি গ্রহণ করেছে। সনদ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে আরো এক ডজন প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, হালাল সনদের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রথম আবেদন করে বেঙ্গল মিট প্রসেসিং। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মাংস রফতানির জন্য ২০০৭ সালের ২৩ জুন এ আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। একই বছরের ২৭ মে তত্কালীন মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সিএস করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেঙ্গল মিটকে হালাল সনদ দেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পরবর্তীতে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সভায় পণ্যের হালাল সনদ প্রদানের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
বেঙ্গল মিটের পর হালাল সনদ পায় আরো ১৪টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে নেসলের ম্যাগি নুডলস, ব্র্যাক চিকেন, আফতাব চিকেন, কাজী অ্যান্ড কাজী টি ও বিক্রমপুর পটেটো ফ্লেক্স।
জানতে চাইলে আফতাব ফুডের পরিচালক এ কে কাইউম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মুসলমান। তাই পণ্যের হালাল সনদ থাকলে ক্রেতার আস্থা বাড়ে। এ কারণেই সনদটি নেয়া হয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরো যারা হালাল সনদ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে, তার মধ্যে আছে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। সব ধরনের পণ্যে হালাল সনদের আবেদন করেছে কোম্পানিটি। একই সনদের জন্য আবেদন করেছে প্রাণের খাদ্যপণ্য ও আমানত শাহ লুঙ্গিও। হালাল সনদের জন্য যোগাযোগ করছে ওরিয়ন গ্রুপ। মাশরুম পণ্যের হালাল সনদ নিতে আগ্রহী তারা। হালাল সনদ চেয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আবেদন জমা দিয়েছে কল্লোল গ্রুপও।
যোগাযোগ করা হলে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের বিপণন বিভাগের প্রধান নাফিসা আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্কয়ারের সব খাদ্যপণ্যই হালাল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার কারণে সনদের প্রয়োজন পড়ছে। এ কারণেই আমরা ইসলামিক ফাউন্ডেশনে হালাল সনদের জন্য আবেদন করেছি।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পণ্যের হালাল সনদ দিলেও এ-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। যদিও নীতিমালা তৈরির জন্য ২০১১ সালের ৪ অক্টোবর ধর্ম মন্ত্রণালয় একটি অফিস আদেশ জারি করে। এর পর একাধিক সভায় এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। পণ্য হালাল কিনা, তা পরীক্ষার নিজস্ব কোনো সক্ষমতাও নেই ফাউন্ডেশনের। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের মৌখিক অনুমোদনেই হালাল সনদ দিচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল দেশের বাইরে থাকায় এ ব্যাপারে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে পণ্য হালাল কিনা, তা যাচাইয়ে পরীক্ষাগার না থাকার কথা স্বীকার করেছেন ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, পণ্য হালাল না হারাম, তা যাচাইয়ে কোনো গবেষণাগার বা পরীক্ষাগার এখানে নেই। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তারও অভাব রয়েছে। তার পরও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এ ধরনের সনদ দেয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বড় বাজার রয়েছে। মুসলিমপ্রধান হওয়ায় বাংলাদেশেও এর চাহিদা বেশি। রফতানি ও স্থানীয় চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে করপোরেটরা হালাল সনদের দিকে ঝুঁকছে। তবে সনদ দেয়ার আগে পণ্য প্রকৃতই হালাল কিনা, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা শরিফুল ইসলাম বলেন, ক্রেতার জানার অধিকার আছে পণ্যটি হালাল কিনা। তবে তা নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। সনদ পাওয়া পণ্যটি যে প্রকৃতই হালাল, তা নিশ্চিত হয়েই সনদ দিতে হবে।
হালাল সনদ পেতে কোম্পানিগুলোকে নিজস্ব প্যাডে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বরাবর আবেদন করতে হয়। সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন ও ভ্যাট সার্টিফিকেট এবং পণ্যের ভিত্তিতে বিএসটিআই, মত্স্য অধিদফতর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সনদ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিএসটিআই, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কাছে উপাদান সম্পর্কে তথ্য চেয়ে থাকে। পরে সরবরাহকৃত তথ্য যাচাই শেষে এক বছরের জন্য পণ্যের হালাল সনদ দিয়ে থাকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রথম দিকে সনদ বাবদ ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ থাকলেও বর্তমানে পণ্য বিক্রির ওপর দশমিক ৮ শতাংশ ফি নির্ধারণ করা হয়।
প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলা বলেন, পণ্য হালাল না হারাম, তা এক ধরনের মান। এটা অবশ্যই যাচাই করে দিতে হবে। সরকারের কোনো পরিপত্র ছাড়াই ইসলামিক ফাউন্ডেশন এটা কীভাবে করছে, অর্থইবা আদায় হচ্ছে কীভাবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ফাউন্ডেশন থেকে ব্যবসায়ীরা যে হালাল সনদ নিচ্ছেন, তা কৌশলমাত্র।
Discussion about this post